নোসিবো ইফেক্ট: মনের ভয় কীভাবে দেহে বাস্তব রোগ সৃষ্টি করে
আপনি কি জানেন, কখনও কখনও ওষুধ নয়, বরং নিজের ভয়ই অসুস্থতার কারণ হয়? এই লেখায় জানুন নোসিবো ইফেক্টের গল্প—যেখানে মস্তিষ্ক, বিশ্বাস ও শরীর এক অদ্ভুত ছন্দে কাজ করে।
.
নোসিবো ইফেক্ট কী?
নোসিবো ইফেক্ট (nocebo effect) এমন এক মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা, যেখানে কেবল নেতিবাচক প্রত্যাশা বা ভয় থেকেই শরীরে বাস্তব উপসর্গ দেখা দেয়। এটি আসলে প্লাসিবো ইফেক্টের উল্টা দিক—যেখানে বিশ্বাস ও আশার ফলে শরীর ভাল বোধ করে, সেখানে নোসিবো ইফেক্টে ভয় ও সন্দেহই অসুস্থতার জন্ম দেয়।
ধরুন, কাউকে বলা হল—“এই ওষুধটি খেলে মাথাব্যথা বা বমি বমি ভাব হতে পারে।” অথচ ওষুধে এমন কোনো উপাদানই নেই। তবুও সে কিছুক্ষণ পর মাথা ঘোরা বা অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করল। কারণ ওষুধ নয়, বরং তার ভয় ও প্রত্যাশাই শরীরে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
“নোসিবো” শব্দটি এসেছে ল্যাটিন nocere থেকে, যার অর্থ “আমি ক্ষতি করব”। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ চিকিৎসক ওয়াল্টার কেনেডি, যিনি ১৯৬১ সালে এই ধারণাটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে সংজ্ঞায়িত করেন। তিনি পেশায় একজন ফিজিওলজিস্ট ছিলেন এবং মানুষের দেহ-মনের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করতেন।
কেনেডি দেখেছিলেন, অনেক সময় ওষুধ নয়, বরং রোগীর নিজের মনই শরীরের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী। তার ভাষায়, এটি একেবারে “subject-centered response”—অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াটি শরীরে নয়, জন্ম নেয় মনের ভেতর থেকে। এই ব্যাখ্যার পর থেকেই “নোসিবো ইফেক্ট” চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটি স্বতন্ত্র ও আলোচিত ধারণা হয়ে ওঠে।
.
ভয়, উদ্বেগ ও শরীরের প্রতিক্রিয়া
নোসিবো ইফেক্ট মূলত কাজ করে ভয়, উদ্বেগ ও নেতিবাচক প্রত্যাশার মাধ্যমে। যখন কেউ কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য শোনেন, তখন মস্তিষ্ক সেই তথ্যকে একটি বাস্তব হুমকি হিসাবে গ্রহণ করে। এর ফলেই শরীরে শুরু হয় স্ট্রেস প্রতিক্রিয়া—যেখানে নিঃসৃত হয় কর্টিসলসহ নানা স্ট্রেস হরমোন। এই হরমোনগুলি রক্তচাপ বাড়ায়, স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে এবং শরীরে টান টান অবস্থা সৃষ্টি করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এ সময় মস্তিষ্কের ব্যথা নিয়ন্ত্রণকারী পথও পরিবর্তিত হয়। সাধারণত এন্ডোরফিন নামের রাসায়নিক ব্যথা কমাতে সাহায্য করে, কিন্তু নোসিবো অবস্থায় এই প্রাকৃতিক ব্যথানাশক কাজ করে না বা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে ব্যথার অনুভূতি বেড়ে যায়।
আর যাদের পূর্বে কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে—যেমন কোনো ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে—তাদের মস্তিষ্কে “নেতিবাচক শর্তায়ন” তৈরি হয়। এর মানে, পরে নিরীহ কিছু পেলেও মস্তিষ্ক একই ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করে এবং সেই অনুযায়ী শরীরে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
বৈজ্ঞানিকভাবে এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। fMRI স্ক্যান দেখিয়েছে, নোসিবো ইফেক্টের সময় মস্তিষ্কের অ্যান্টেরিয়র সিঙ্গুলেট কর্টেক্স (ACC) ও প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স সক্রিয় হয়ে ওঠে। এছাড়াও ডোপামিন ও সেরোটোনিন নামের নিউরোট্রান্সমিটার এবং CCK (কোলেসিস্টোকিনিন) নামের এক পেপটাইড হরমোনেরও বড় ভূমিকা আছে। এই হরমোন ব্যথার সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে দেয়, যেন মনস্তাত্ত্বিক ভয় বাস্তব ব্যথায় রূপ নেয়।
.
বাস্তব জীবনের চমকপ্রদ উদাহরণ
নোসিবো ইফেক্টের উপস্থিতি সবচেয়ে স্পষ্ট হয় চিকিৎসা ও সমাজজীবনে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা যায়, যারা আসলে প্লাসিবো—অর্থাৎ সক্রিয় ওষুধ নয়, শুধু চিনির ট্যাবলেট—পান, তাদের অনেকেই মাথাব্যথা, ক্লান্তি বা বমি বমি ভাবের মত উপসর্গ অনুভব করেন। তারা অসুস্থ হন না ওষুধে, বরং অপেক্ষায়, যা তাদের মস্তিষ্ক তৈরি করে।
কিছু মানুষ আবার বিশ্বাস করেন যে তারা ওয়াইফাই, মোবাইল টাওয়ার বা রাসায়নিক পদার্থের প্রতি সংবেদনশীল। বাস্তবে ক্ষতির প্রমাণ না থাকলেও, বিশ্বাসের শক্তিতেই তাদের শরীরে অস্বস্তি, মাথাব্যথা বা অনিদ্রার মত উপসর্গ দেখা দেয়।
একইভাবে, সমাজে কোনো রোগ বা মহামারী নিয়ে ভয় ছড়িয়ে পড়লে, অনেক সুস্থ মানুষও সেই রোগের উপসর্গ অনুভব করতে শুরু করে। একে বলা হয় “মাস নোসিবো” বা গণ-মানসিক অসুস্থতা—যেখানে ভয়ের সংক্রমণ ছড়ায় এক মন থেকে আরেক মনে।
অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা দেখা যায়। যেসব রোগীকে আগে বলা হয় “অপারেশনের পর ব্যথা হতে পারে”, তারা সত্যিই বেশি ব্যথা অনুভব করেন। অথচ যাদের কিছু বলা হয়নি, তারা তুলনামূলকভাবে আরামদায়ক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যান।
এই ধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়ার সবচেয়ে নাটকীয় উদাহরণ দেখা যায় কিছু প্রাচীন সংস্কৃতিতে, যেখানে “বিশ্বাস” শুধু মন নয়, শরীরকেও নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন—হাইতির ভুডু প্রথা। সেখানে অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন, কোনো “বোকর” বা জাদুকর যদি কাউকে অভিশাপ দেয়, তবে সেই অভিশাপ তার শরীরে প্রভাব ফেলতে পারে।
যাকে অভিশাপ দেওয়া হয়, সে প্রায়ই আতঙ্ক, অনিদ্রা, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা অসুস্থতার লক্ষণ দেখাতে শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে এই ভয় এতটাই গভীর হয় যে, ব্যক্তি আসলে কোনো শারীরিক আঘাত ছাড়াই অজ্ঞান হয়ে পড়ে বা মৃত্যুবরণ করে।
আধুনিক গবেষকরা এই ঘটনাকে নোসিবো ইফেক্টের চরম উদাহরণ হিসেবে দেখেন—যেখানে বিশ্বাসের শক্তি মস্তিষ্কে এমন রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ঘটায়, যা হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ও স্নায়ুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।
অস্ট্রেলিয়ার কিছু আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে “পয়েন্টিং বোন” নামের এক রহস্যময় রীতি। এখানে একজন জাদুকর (যাকে “কুরদাইচা ম্যান” বলা হয়) অপরাধী বা সমাজবিরোধী ব্যক্তির দিকে হাড়ের একটি বিশেষ দণ্ড নির্দেশ করেন। বিশ্বাস করা হয়, এই দণ্ডের দিকেই মৃত্যু লুকিয়ে থাকে।
যাকে “পয়েন্ট” করা হয়, সে জানে যে তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়েছে—এবং ভয়, অপরাধবোধ ও সামাজিক চাপের কারণে প্রায়ই কয়েক দিনের মধ্যেই তার দেহ ভেঙে পড়ে, খাবার গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত সে মারা যায়। পরে মেডিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে, তাদের শরীরে কোনো বিষ বা শারীরিক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মৃত্যু ঘটেছে মানসিক ভয় এবং আত্মসমর্পণের ফলেই।
.
সংস্কৃতি, চিকিৎসা ও নৈতিকতার টানাপোড়েন
নোসিবো ইফেক্ট শুধু মানসিক বা শারীরবৃত্তীয় বিষয় নয়। এটি সংস্কৃতি, তথ্য ও নৈতিকতার মধ্যকার সূক্ষ্ম সম্পর্কও তুলে ধরে।
পশ্চিমা সমাজে যেখানে চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য খোলাখুলি জানানো হয়, সেখানে নোসিবো ইফেক্ট দেখা যায় মূলত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত ভয়ে। অন্যদিকে, যেসব সমাজে অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস বেশি, সেখানে অভিশাপ বা জাদুবিদ্যা-নির্ভর নোসিবোই বেশি দেখা যায়।
এখানেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের নৈতিক সংকট—“ইনফর্মড কনসেন্টের দ্বন্দ্ব”—রোগীকে সম্ভাব্য ঝুঁকি জানানো চিকিৎসকের দায়িত্ব, কিন্তু সেই তথ্যই অনেক সময় রোগীর মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়।
আজকের ডিজিটাল যুগে এই সমস্যা আরও বেড়েছে। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে রোগীরা নিজেরাই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে অনুসন্ধান করেন, অন্যের অভিজ্ঞতা পড়েন, এবং অজান্তেই সেই উপসর্গ নিজের মধ্যে অনুভব করতে শুরু করেন। এই ঘটনাকেই বলা যায় “ডিজিটাল নোসিবো”—যেখানে তথ্যই ভয় হয়ে ওঠে।
চিকিৎসকরা চান না রোগী না জানার মধ্যে থাকুক, আবার চান না সে ভয় পাক। তাই এর সমাধান হতে পারে—
১. ইতিবাচক ভাষা ব্যবহার: যেমন “এই ওষুধে বমি হতে পারে” না বলে বলা—“অধিকাংশ রোগীর কোনো সমস্যা হয় না, অল্প কিছু ক্ষেত্রে হালকা অস্বস্তি দেখা দেয়।”
২. ভারসাম্যপূর্ণ তথ্য প্রদান: ঝুঁকি বলার পাশাপাশি ওষুধের সুফল ও ঝুঁকি ঘটার সম্ভাবনা কতটা কম, সেটিও ব্যাখ্যা করা।
৩. কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT): যা রোগীর নেতিবাচক চিন্তা ও ভয় দূর করতে সাহায্য করে।
৪. মাইন্ডফুলনেস ও মেডিটেশন: যা মানসিক প্রশান্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়ায়।
.
ইতিহাস থেকে বর্তমান পর্যন্ত
নোসিবো ইফেক্টের ধারণা এসেছে প্লাসিবো গবেষণার ইতিহাস থেকে।
১৮শ শতকের জার্মান চিকিৎসক ফ্রান্জ মেসমার “অ্যানিম্যাল ম্যাগনেটিজম” নামে এক চিকিৎসা-পদ্ধতি চালু করেন। তিনি দাবি করেছিলেন, চুম্বকীয় তরল মানবদেহে প্রবাহিত হয়ে রোগ সারাতে পারে। কিন্তু বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের নেতৃত্বে এক ফরাসি কমিশন পরীক্ষায় দেখল, যাদের বলা হয়েছিল তাদের ওপর চুম্বক প্রয়োগ হচ্ছে, তারা প্রকৃতপক্ষে কোনো চৌম্বক স্পর্শ না পেলেও কাঁপুনি, ঘাম ও ব্যথা অনুভব করেছেন। এই প্রতিক্রিয়াই ছিল নোসিবো ইফেক্টের প্রথম চিহ্ন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট হেনরি বিচার লক্ষ্য করেন, অনেক সৈনিক নরমাল স্যালাইন ইনজেকশন পেলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করেন। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত প্রবন্ধে তিনি প্রথম লেখেন, “প্লাসিবো কখনও আরোগ্য আনে, আবার কখনও বিষের মত কাজ করে।”
১৯৬১ সালে ওয়াল্টার কেনেডি “নোসিবো” শব্দটি ব্যবহার করে একে সংজ্ঞায়িত করেন। এরপর ১৯৯০-এর দশকে মনোবিজ্ঞান ও নিউরোসায়েন্সে অগ্রগতির ফলে এই বিষয়ে নতুনভাবে আগ্রহ জন্মে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হারবার্ট বেনসন ১৯৯৭ সালে “The Nocebo Effect: History and Physiology” প্রবন্ধে এর শারীরবৃত্তীয় ও মানসিক দিক ব্যাখ্যা করেন।
২১শ শতকে এসে বিষয়টি আরও আলোচনায় আসে। কোভিড-১৯ টিকার পর দেখা কিছু “পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া” আসলে নোসিবো ইফেক্ট কিনা, তা নিয়েও গবেষণা চলছে। এমনকি “হাভানা সিনড্রোম”-এর মত রহস্যময় ঘটনাকেও অনেকে এখন মানসিক নোসিবো প্রতিক্রিয়ার ফল হিসাবে দেখছেন।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করছেন—কিছু মানুষ কি জিনগতভাবে নোসিবো ইফেক্টের প্রতি বেশি সংবেদনশীল? আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে রোগীর মানসিক প্রোফাইল বুঝে কীভাবে চিকিৎসা তথ্য এমনভাবে উপস্থাপন করা যায় যাতে ভয় না বাড়ে বরং সচেতনতা বাড়ে—এই নিয়েও চলছে গবেষণা।
.
নোসিবো ইফেক্ট আমাদের শেখায়—মানুষের মস্তিষ্ক শুধু চিন্তা করে না, তা শরীরের ভেতরেও প্রতিধ্বনি তোলে। ভয়, সন্দেহ, প্রত্যাশা—সবই শরীরের রাসায়নিক ভারসাম্য পাল্টে দিতে পারে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের সামনে আজ এক বড় চ্যালেঞ্জ: রোগীকে প্রয়োজনীয় তথ্য জানানো, কিন্তু এমনভাবে যেন তার মনে আতঙ্ক না জন্মায়। কারণ মনের শক্তি যেমন নিরাময় আনতে পারে, তেমনি ভয়ও রোগের জন্ম দিতে পারে।
তথ্যে ভরপুর এই যুগে, যেখানে প্রত্যেকে নিজের চিকিৎসক, সেখানে সচেতনতার পাশাপাশি মনোভাবের ভারসাম্যই হতে পারে প্রকৃত আরোগ্যের চাবিকাঠি। নোসিবো ইফেক্ট আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিশ্বাস শুধু রোগ সারায় না, কখনও কখনও সেটিই রোগের সৃষ্টি করে।
Comments
Post a Comment