Tuesday, September 5, 2023

সাড়ে ৩ হাত জমি

বড় বোন ব্যবসায়ীর স্ত্রী, থাকে শহরে। ছোট বোন কৃষকের স্ত্রী, থাকে গ্রামে। বড় বোন এসেছে ছোট বোনের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে। চা খেতে খেতে দুই বোন গল্প করছিল। বড় বোন বলছিল শহরে থাকার সুযোগ-সুবিধার কথা। বেশ বাড়িয়ে বলা। যাকে বলে গল্প দেওয়া। ছোট বোনও গ্রামে থাকার ভালো দিকগুলোর কথা বলে।

ছোট বোনের স্বামী পাখোম সব শুনছিল। সে বলল, ‘কথা ঠিক। ছোটবেলা থেকেই মাটির কোলে পড়ে আছি। তাই বলে তেমন কোনো অভাব নেই। অভাব কেবল একটিই, আমার জমি খুব কম। জমি যদি পাই তা হলে কাউকে পরোয়া করব না, স্বয়ং শয়তানকেও না।’

শয়তান শুনে বেশ খুশি হলো। ভাবল, একে নিয়ে মজার একটা খেলা খেলবে। আগে অনেক জমি দেবে, তারপর কেড়ে নেবে।
পাখোমের জমি ক্রয়

পাখোমের বাড়ির কাছে একজন মহিলা বাস করতেন। তিনি ছিলেন ২৪০ একর জমির মালিক। ভালো মানুষ তিনি। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার সম্পর্কও ভালো। অবসরপ্রাপ্ত একজন সৈনিককে জমিদারির ওভারশিয়ার নিযুক্ত করলেন তিনি। ওভারশিয়ার লোকটি ভালো নয়। নানা ছলছুতায় কৃষকদের জরিমানা করে সে। কারো গরু, ঘোড়া, বাছুর জমি জিরাতে ঢুকলেই সে জরিমানা করে, অত্যাচার করে। এরই মধ্যে শোনা গেল জমিদার মহিলা তার সব জমি বিক্রি করে দেবেন। আর ওভারসিয়ার কিনে নেবে তার সম্পত্তি। কৃষকরা খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে। শেষে সবাই মিলে বেশি দামে জমি কেনার প্রস্তাব দেয় মহিলাকে। মহিলা রাজি হলো। কিন্তু শয়তানের ইন্ধনে তারা একত্রিত হতে পারছিল না। তাই যার যার মতো জমি কেনার সিদ্ধান্ত হয়।

পাখোমের ১০০ রুবল আগেই ছিল। তারপর একটি গাধার বাচ্চা ও অর্ধেক মৌমাছি বিক্রি করল সে। ছেলেকেও পাঠিয়ে দিল চাকরিতে। এভাবে বাকি অর্ধেক টাকা জোগাড় হলো। সব টাকা জুটিয়ে সে তিরিশ একর জমি ও ছোট একটি বাগান ক্রয় করল। বেশ, পাখোম হয়ে গেল জমির মালিক। তারপর নতুন জমিতে বীজ বুনল, ফসল ফলল প্রচুর। এক বছরের মধ্যেই সে মহিলার সমস্ত টাকা শোধ করে দিল। এখন সে জমির পুরো মালিক। গভীর যত্ন আর মায়া দিয়ে সে ফসল ফলাত। ঘোড়ায় চড়ে সে জমিজমা দেখতে গিয়ে আনন্দে অভিভূত হয়। গভীর যত্ন আর মায়া দিয়ে সে ফসল ফলাত। তার জমির ঘাসগুলো, ফুলগুলো-সবই যেন আলাদা। মন তার আনন্দে ভরে ওঠে।
পাখোমের বাড়িতে অতিথি চাষি

একজন চাষি পাখোমের বাড়ি আসে। পাখোম তাকে থাকতে দেয়, খেতে দেয়। সে জানায়, ভলগার ওপার থেকে সে এসেছে। সে আরও বলে, সেখানে নতুন একটি পত্তনি হয়েছে। গ্রাম্য পঞ্চায়েতে নাম লেখালেই ১০০ একর জমি পাওয়া যায়। আর সে কী জমি! সোনার টুকরো। লোকটি আরও বলে, একজন গরিব চাষি এল। কাজ করার দুখানা হাত ছাড়া কিছুই তার ছিল না। এবার সে ১০০ একর জমিতে শুধু গমই ফলিয়েছে। গত বছর শুধু গম বেচে সে আর্ন করেছে ৫০০০ রুবল। শুনে পাখোম উত্তেজিত হয়ে ওঠলো।

তার বর্তমান সহায়-সম্পত্তি নিয়ে সে আর সন্তুষ্ট থাকতে পারল না। সুতরাং গরম পড়তেই সে বেরিয়ে পড়ল। ভলগা নদীতে স্টিমারে চড়ে পৌঁছল সামারা। সেখান থেকে প্রায় ২৭৪ মাইল পায়ে হেঁটে পৌঁছল গন্তব্যে। গিয়ে দেখল, যেটি সে শুনেছে সবই ঠিক। অতি অল্প দামে উর্বর জমি কেনা যায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, প্রতি একরের দাম মাত্র ১.৫০ রুবল। পাখোম বাড়িতে ফিরে জমিজিরাত বিক্রি করে দেয়। বসন্তের শুরুতে সে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সেই নতুন দেশে পাড়ি জমায়।
নতুন দেশে পাখোম

নতুন দেশে এসে পাখোম এ সমাজের সদস্য হয়। আর সদস্য হওয়াতেই সে লাভ করে ১০০ একর জমি। গো-চারণ ভূমি তো আছেই। এখানে জীবনযাপন আগের চেয়ে দশগুণ ভালো। পাখোম নতুন নতুন জমি কেনে। ফসল বোনে। লাভ হয় প্রচুর। একবার তো ১০০০ একর জমিই মাত্র ১৫০০ রুবলে কিনে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু এ সময় একজন মহাজন বাড়িতে এসে ওঠে। সে জানায় অনেক অনেক দূরের বাসকিরদের দেশ থেকে সে এসেছে। সেখানে জমির দাম খুবই সস্তা। ১০০০ রুবল দিয়ে সে ১০,০০০ একর জমি কিনেছে। পাখোমকে জমির দলিলটিও দেখাল। লোকটি আরও জানায় যে, মানুষগুলো একেবারে ভেড়ার মতো সরল। আপনি অনায়াসে যে-কোনো জিনিস তাদের কাছ থেকে বাগিয়ে নিতে পারেন। সুতরাং পাখোম কেন ১৫০০ রুবল দিয়ে ১০০০ একর জমি কিনবে? ঐ রুবল দিয়ে সেতো একজন জমিদারই বনে যেতে পারে।
বাসকিরদের দেশে পাখোম

একজন মজুর সঙ্গে নিয়ে বাসকিরদের দেশে যাওয়ার জন্য যাত্রা করল পাখোম। সঙ্গে নিল কিছু উপহার। প্রায় ৩৩২ মাইল পথ হেঁটে গেল তারা। তারপর সাত দিনের দিন বাসকিরদের তাঁবুতে গিয়ে হাজির হলো। মহাজন যেমন বলেছিল সব ঠিক সেরকমই। খোলা প্রান্তরের নদীটির তীরে এরা বাস করে। ঘরবাড়ি নেই। আছে চামড়ার ছাউনি দেয়া গাড়ি। এর মধ্যেই তাদের বসবাস। এরা জমি চাষ করে না, ফসল ফলায় না। জমিতে চরে বেড়ায় ঘোড়া, গরু, মহিষ। ঘোড়ার দুধ এদের প্রিয় খাদ্য। ভেড়ার মাংসও খায়। দুধ থেকে তৈরি কুসিম তাদের পানীয়। এরা সহজ-সরল, দয়ালু ও হাসিখুশি। পাখোমকে দেখেই তারা গাড়ি থেকে নেমে অভ্যর্থনা জানাল, আদর-অপ্যায়ন করল। পাখোমও তাদের উপহার দিল। বিনিময়ে তারা জানতে চাইল যে পাখোম কী চায়? তারা জানল, পাখোম জমি কিনতে চায়। শুনে তারা অতিথির প্রতি খুবই সন্তুষ্ট হলো। তারা বলল, ‘আপনি যত জমি চান তত জমি আমরা বিক্রয় করতে রাজি।’ এ সময় তাদের নেতা স্টার্শিনা এসে সবকিছু শুনলেন। তিনিও জানালেন, পাখোম যত খুশি জমি ক্রয় করতে পারে। জমির দাম দিনপ্রতি ১০০ রুবল। ‘দিনপ্রতি’ ব্যাপারটা পাখোম উঠতে পারল না। নেতা জানালেন, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যতটা জমি ঘুরে আসতে পারবে ততটুকু জমির মূল্য।
পাখোমের স্বপ্ন

পাখোম শুয়েছিল পাখির পালকের বিছানায়। খুব আরামদায়ক। কিন্তু তবুও তার ঘুম হয়নি। অনেক জমির মালিক হতে যাচ্ছে সে। ২০,০০০ একর তো বটেই। চিন্তায় উত্তেজনায় সারা রাত সে ঘুমোতে পারল না। কিন্তু ভোরের দিকে সে ঘুমিয়ে পড়ল। একটা স্বপ্নও দেখল। বাইরে যেন কার হাসির শব্দ। স্বপ্নেই সে বেরিয়ে গেল। দেখল স্টার্শিনা। একটু এগিয়ে দেখল লোকটি স্টার্শিনা নয়, সেই মহাজন। এই লোকটিই তাকে এখানে আসতে বলেছিল। কিছু জিজ্ঞাসা করতেই লোকটি যেন বদলে গেল। এখন সে ভলগার ভাটি থেকে আসা সেই চাষি। সব শেষে পাখোম দেখল, এ হচ্ছে একটি শয়তান; মাথায় শিং, পায়ে খুর। বিকট শব্দ করে সে হাসছে। অদূরে একটি লোক পড়ে আছে। তার মুখ কাগজের মতো সাদা। লোকটির দিকে তাকিয়ে পাখোম দেখল, লোকটি সে নিজে। তার দম যেন আটকে এল। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গেল ঘুম। চারদিকে ফর্সা হয়ে গেছে। এখনই সূর্য উঠবে। তাকেও জমি-দখলের দৌড় শুরু করতে হবে।
পাখোমের প্রয়োজনীয় জমি

শিকান নামে একটি গোল পাহাড়। এই পাহাড়ের উপর স্টার্শিনা তার টুপি রাখল। টুপির মধ্যে পাখোমের ১০০ রুবল। এখান থেকেই তার যাত্রা শুরু। পাখোম দেখল সবই উর্বর জমি, সোনার টুকরো। অনেক চিন্তা করে সে সূর্য-উদয়ের দিকে যাত্রা করল। আস্তেও নয়, খুব জোরেও নয়। ১১৬৬ গজ যাবার পর সে একটু থামল। একটি খুঁটি পুতল। এখন সে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতে লাগল। থেমে আর একটি খুঁটি পুতে দিল। সূর্যের দিকে তাকাল একবার। গোল পাহাড়টার ওপর আলো পড়েছে। পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ওপরও আলো পড়েছে। হিসাব করে দেখল, প্রায় সাড়ে তিন মাইল পথ হাঁটা হয়েছে। আরও সাড়ে তিন মাইল হেঁটে সে বাঁ-দিকে মোড় নেবে। শরীর তার গরম হয়ে উঠেছে। কোট খুলে ফেলল, জুতাও। হাঁটতে তার খুব ভালো লাগছিল। তাই ভালো ভালো জমি দেখে বাঁক- মোড় নিতে লাগল।

গোল পাহাড়টা এখন আর দেখা যায় না। পাখোম ভাবল : মোড়টা বেশ বড় হয়েছে নিশ্চয়। তার শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। সে ক্লান্ত বোধ করছে। সে খানিকটা পানি খেল। একটি খুঁটিও পোতা হলো। পথে বড় বড় ঘাস। ভ্যাপসা গরম। তার ভিতর দিয়ে সে ছুটতে লাগল।

ঠিক দুপুরে সে সামান্য রুটি খেল। দাঁড়িয়ে সামান্য জিরিয়েও নিল। মাটিতে সে বসল না। কারণ বসলে শুতে ইচ্ছে হবে, আর শুলে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। রুটি খাওয়ার পর হাঁটতে সুবিধা হলো। কিন্তু সামান্য পরেই তার শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। কিন্তু শরীরকে আসকারা দিলে চলে না। কেননা সামান্য কষ্টেই তার অনেক লাভ।

সাড়ে ছয় মাইল পথ সে পেরিয়েছে। তার পরও কিছু উর্বর জমি ছেড়ে আসতে পারেনি। কী করে ছাড়ে। চমৎকার তিসি হবে এ জমিগুলোতে। গোল পাহাড় থেকে ১০ মাইল পথ দূরে এসেছে সে। আর পশ্চিম আকশে সূর্য অনেকটা হেলে গিয়েছে। অথচ সে ফিরতে পেরেছে ১ মাইলের চেয়ে সামান্য বেশি। এখন সে আর কোনো বাঁক নিচ্ছে না। সোজাসুজি হেঁটেও সে যেন এগুতে পারছে না। জুতা সে খুলে ফেলেছিল অনেক আগেই। এখন খালি পা কেটে ছিঁড়ে গিয়েছে। হাঁটতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। শরীর কাঁপছে। পা কাঁপছে। একটু বিশ্রামের বদলে সে সব কিছু দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বিশ্রাম করলে চলবে না। তাই কে যেন চাবুক মেরে মেরে তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কত পথ বাকি। অথচ সে মৃত প্রায়। এত পথ সে পেরিয়ে এসছে। কী করে তা ফিরে যাবে।

কিন্তু ফিরতে তাকে হবেই। সব অর্থ, সব পরিশ্রম বৃথা যেতে পারে না। পা ফেটে রক্ত ঝরছে। তবুও সে দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে। তবুও যেন এগুতে পারছে না। কোট, জুতা, ফ্লাস্ক, টুপি সব ছুড়ে ফেলে দিল। তবুও দৌড়াতে তার দারুণ কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভিতর কে যেন হাপর টানছে। হৃৎপিন্ডের ভিতরে মারছে হাতুড়ি। পা দুটি দেহের ভার সইছে না, ভেঙে পড়ছে।

জমির কথা সে ভুলে গেল। নিজেকে বাঁচানোই এখন একমাত্র চিন্তা। সূর্য এখন অস্ত যাওয়ার পথে। গোল পাহাড়ের লোকগুলো তাকে ডাকছে। চিৎকার করে তাকে উৎসাহ দিচ্ছে। সে শেয়ালের চামড়ার টুপিটি মাটিতে পড়ে থাকতে দেখল। তার ভিতরে টাকা। তার পাশে দাঁড়িয়ে স্টার্শিনা। তার স্বপ্নের কথা মনে হলো। তবুও সে পৌঁছাতে চায়। নিজেকে সে খুন করেছে। তুবুও দৌড় বন্ধ করল না। সূর্য যখন অস্ত গেল তখন সে পাহাড় ছুঁয়েছে। একটি মুমূর্ষু জন্তুর মতো সে পাহাড় ডিঙিয়ে টুপিটি স্পর্শ করল। স্পর্শ করতে করতে সে নিচে পড়ে গেল। স্টার্শিনা চিৎকার করে উঠল, ‘হায় যুবক, অনেক জমি তুমি পেলে বটে।’ পাখোমের মজুর ছুটে গেল তার কাছে। তাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করল। তখন তার মুখ দিয়ে রক্তের ধারা বইছে।

পাখোম মারা গেল। স্টার্শিনা হাসতে লাগল। শেষে সাড়ে তিন হাত জমির মধ্যে পাখোমের সমাধি হলো।

রূপান্তর : প্রফেসর ড. সরকার আবদুল মান্নান

No comments:

Post a Comment