"ইয়ে মানে আপনি নোবেল পাচ্ছেন বটে, কিন্তু প্রাইজটা নিতে আসবেন না প্লিজ। এমন চরিত্রহীনা নারী পুরস্কার নিতে এলে খুব বদনাম হবে আমাদের! আমরা.... আমরা আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব প্রাইজ।"
১৯১১ সাল। সারা দুনিয়াকে চমকে দিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য নোবেল প্রাইজ ঘোষণা হল বিজ্ঞানী মাদাম মেরি কুরির নামে। তার আগে দ্বিতীয়বার নোবেল কেউ পাননি। তাও আবার দুটো আলাদা বিভাগে!
অথচ কী আশ্চর্য, নাম ঘোষণা করেই স্টকহোমের নোবেল কমিটি তড়িঘড়ি মেরি কুরিকে চিঠি লিখল,“দয়া করে আপনি কিন্তু পুরস্কার নিতে আসবেন না। আমরা আমাদের বদনাম চাইছি না। প্লিজ মাদাম! আমরা আপনাকে পুরস্কারটি পাঠিয়ে দেব যথাসময়ে।"
মেরি কুরি বিস্মিত। আহতও। আটবছর আগে স্বামী পিয়েরের সঙ্গে যৌথভাবে যখন প্রথম নোবেল প্রাইজটি পেয়েছিলেন, অসুস্থতায় দুজনের কেউই যেতে পারেননি, এবার কেন যাবেন না? তিনি তো কোন অন্যায় করেননি! দৃঢ়ভাবে তিনি জানিয়ে দিলেন,“আমি পুরস্কার নিতে যাব। যাবই। ধন্যবাদ।”
নোবেল কমিটি পড়ল মহা ফ্যাসাদে। মেরি কুরির নাম যখন ইন্টারনাল কমিটিতে চূড়ান্ত হয়েছে, তখনো অবধি যে তাঁদের হাতে এসে পড়েনি হাতে গরম ফরাসী সংবাদপত্রগুলো! কিন্তু সেগুলোয় যে এখন ছেয়ে যাচ্ছে কেচ্ছা। বিশ্বের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী মাদাম মেরি কুরি নাকি পরকীয়ায় লিপ্ত! তাও আবার মৃত স্বামীর ছাত্র পলের সঙ্গে।
নানারকম কাল্পনিক প্রতিবেদনে তখন ফরাসী মিডিয়া লাগাতার আক্রমণ করে চলেছে দেশের সবচেয়ে প্রতিভাবান নারীটিকে। দেশের নাগরিকরা জঘন্যতম বিশেষণে ছিছিক্কার করছে। সবার মনেরই চাপা অসন্তোষ ফেটে বেরোচ্ছে এখন উল্লাসে। আহা, গত কয়েকদশক ধরে যতই দেশের নাম উজ্জ্বল করুক, মেয়ে হয়ে এত বাড়বাড়ন্ত কি ভাল বাপু? মেয়ে হয়েছ, আর্ট পড়ো, তা নয় সায়েন্সে গেছে। দেশের পুরুষগুলো বসে আছে, আর যত রাজ্যের পুরস্কার থেকে বড় বড় বিজ্ঞান সংস্থার মাথায় কিনা একটা মেয়েমানুষ …!
বিখ্যাত প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে তাবড় তাবড় অধ্যাপকরা পড়ানোর সুযোগ পান না। সেখানে কিনা প্রথম মহিলা অধ্যাপক হিসেবে জয়েন করেছেন। না, এতটা মেনে নেওয়া যায় না। সুযোগ যখন একটা পাওয়া গেছে, সেটা কেউ ছাড়ে? তার ওপর মেরি ফ্রান্সের ভূমিকন্যা নন, পোল্যান্ডে জন্ম তাঁর। অন্য দেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসায় জনসাধারণের আক্রোশ হয়ত আরো বেশি।
নিজের জগতে এমনিই বহু পুরুষ বিজ্ঞানী সহ্য করতে পারতেন না মেরিকে, তাঁরাও পরোক্ষ সমর্থনে তাতাতে লাগলেন জনতাকে। কেউ পল মেরির পরকিয়া নিয়ে আজগুবি সাক্ষাতকার দিয়ে লাইমলাইটে আসতে চাইছিলেন, কেউ অন্য কোনভাবে। বিংশ শতকের গোড়ার রক্ষণশীল ইউরোপীয় সমাজ ফুঁসছিল। এই মেয়েই কিনা আগে গর্বোদ্ধত সুরে বলেছিল, "মানুষ হওয়ার যাবতীয় অধিকার আমাদের সমাজে পুরুষরাই মনোপলি নিয়ে রেখেছে।"
উদ্ধত মেয়েটাকে এবার বাগে পাওয়া গেছে।
মেরির স্বামী পিয়ের শুধু তাঁর জীবনসঙ্গী ছিলেন না, ছিলেন গবেষণার সহকর্মী থেকে সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সেই পিয়েরের হঠাৎ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে মেরি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। কাজে হারিয়ে ফেলেছিলেন উৎসাহ।
সেই সাংঘাতিক মানসিক বিপর্যয়ে তিনি হয়ত মানসিক আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন পদার্থবিদ পল লজেভঁ-র কাছে। পল ছিলেন পিয়ের কুরিরই ছাত্র, মেরির চেয়ে বছরপাঁচেকের ছোট। পলের সঙ্গে মানসিক আদানপ্রদানে মেরি ক্রমশই জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসছিলেন। পল নিজেও বিবাহিত ছিলেন, যদিও স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়ে গেছে আগেই। আলাদা থাকেন বহুদিন।
দুই একাকীত্বে ভোগা বিজ্ঞানীর বন্ধুত্ব হয়ত দুজনকেই শান্তি দিচ্ছিল। কিন্তু পলের প্রাক্তন স্ত্রী জেনি কী করে যেন পেয়ে গেলেন দুজনের কিছু চিঠিপত্র! রাগে ক্ষোভে উন্মত্ত জেনি মেরিকে খুনের হুমকি তো দিলেনই, দেশের কাছে দেবীস্বরূপা মেরির ইমেজ একেবারে টুকরো টুকরো করে দিতে সেই চিঠিগুলো তুলে দিলেন মিডিয়ার হাতে।
ব্যাস, আর কি! মিডিয়া লুফে নিল। সাধারণ চিঠির ওপর ক্রমাগত রঙ চড়িয়ে পরিবেশিত হতে লাগল রগরগে কেচ্ছা। এমনকি কিছু কিছু কাগজে কিস্তিতে ছাপা হতে শুরু করল মেরি – পলের কাল্পনিক প্রেমকাহিনী। প্রকাশিত হতে লাগল পলের স্ত্রী ও শ্বাশুড়ির সাক্ষাৎকারও। পল যে আগে থেকেই বিবাহবিচ্ছিন্ন, সেই তথ্যটাকে ‘ফুটেজ’ এর লোভে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হতে লাগল, বারবার বলা হতে লাগল, মেরি পলের সংসার ভাঙছেন।
সাংবাদিক গুস্তেভ টেরি আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে লিখলেন,“আসলে পিয়ের বেঁচে থাকতেই এই পরকীয়া শুরু। পিয়েরের মৃত্যু মোটেই অ্যাক্সিডেন্ট নয়, স্ত্রীর এই বিশ্বাসঘাতকতায় পিয়ের নিজেই ঘোড়ার গাড়ির তলায় ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করেন।”
এমন জলজ্যান্ত মিথ্যাচারে মেরি হতবাক। স্বামী পিয়ের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন মেরির প্রিয়তম বন্ধু। তিনি জীবিত থাকার সময়ে পলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তো দূর, ভালভাবে পরিচয়ও ছিল না মেরির।
কিন্তু উত্তেজিত জনতা আর কবে যুক্তি দিয়ে কিছু বুঝতে চেয়েছে? যুক্তির চেয়ে গুজবের শক্তি বরাবরই বেশি। সাংবাদিক গুস্তেভ টেরির ওই প্রতিবেদনে আগুনে ঘি পড়ল যেন। জ্যান্ত মানুষের সম্মানের চেয়ে মরা পিয়েরকে ছদ্ম সমবেদনা জানানোর লোক কয়েকশো গুণ বেশি।
যে মানুষটা বিশ্বদরবারে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন, সেই মেরি কুরিরই বাড়ি ঘেরাও করে চলল উন্মত্ত জনতার বিক্ষোভ আর তাণ্ডব। সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ আর হুমকি। সন্তানদের নিয়ে তখন ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছেন নোবেলজয়ী কিংবদন্তী বিজ্ঞানী মেরি। মানসিকভাবে একেবারে তলানিতে তিনি।
ওদিকে বিজ্ঞানী পলের কাজ রিসার্চ সবই গেছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি, বললেন,“সাংবাদিক গুস্তেভ টেরি সাংবাদিকতার লজ্জা। উনি সংবাদ নয়, মিথ্যে রগরগে কেচ্ছা পরিবেশনে সিদ্ধহস্ত। আমি ওঁকে আমার সঙ্গে ডুয়েল যুদ্ধে লড়ার জন্য আহ্বান করছি।”
মুখোমুখি দাঁড়ালেন সাংবাদিক ও বিজ্ঞানী। দুজনের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু শেষমেশ ডুয়েল লড়া হল না। সাংবাদিক টেরি অবজ্ঞাভরে লিখলেন,“চাইলেই আমি এক গুলিতে পলকে হারাতে পারতাম, কিন্তু আমি চাই না দেশ একজন বরেণ্য বিজ্ঞানীকে অকালে হারাক!”
তারই মাঝে এল মেরির দ্বিতীয়বারের নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ। লোকজন গর্বিত হওয়ার বদলে আরো ক্ষেপে উঠল। বাইবেলে আছে, চরিত্রহীনা নারী হল ঘোর পাপিষ্ঠা, এমন একজন কিনা সুইডেনের রাজার হাত থেকে পুরস্কার নেবেন? তাতে বুঝি রাজার হাতের পবিত্রতা থাকবে? হতেই পারে না।
কাগজে ছেয়ে যেতে লাগল শ্লোগান। ‘মেরি কুরিকে কিছুতেই নোবেল প্রাইজ নিতে দেওয়া যাবে না। ব্যান করা হোক মেরি কুরিকে। এখুনি। আমাদের রাজার হাত অপবিত্র হতে দেওয়া যাবে না।'
এদিকে নোবেল সংগঠকরা মহা ফ্যাসাদে। ভেতরে ভেতরে পুরোপুরি ভেঙে গিয়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মেরি। ছোট থেকে ভয়াবহ দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে উঠে এসেছেন তিনি। এত সহজে নিজেকে ফুরিয়ে যেতে দেবেন না। জ্যেষ্ঠা কন্যা আইরিন ও দিদি ব্রোনিয়াকে নিয়ে মাথা উঁচু করে স্টকহোম পৌঁছলেন তিনি। যাবতীয় বিক্ষোভকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সুইডেনের রাজার হাত থেকে বিশ্বের সর্বপ্রথম মানুষ হিসেবে নিলেন দ্বিতীয় নোবেল পুরষ্কার। নোবেল প্রাইজ বক্তৃতায় বারবার বললেন স্বামী পিয়েরের কথা।
ফরাসী মিডিয়া যদিও পাত্তাই দিল না এতবড় গৌরবটিকে। মেরির ওপর জঘন্য আক্রমণ চলতেই থাকত। নারী, তার ওপর সফল নারীকে চারিত্রিক দোষ দিয়ে টুকরো করে দেওয়ার মত বিজয়োল্লাস আর কিছুতেই নেই।
চরম মানসিক জোর থাকা মানুষগুলোর শরীর কখনো কখনো তাঁদের মানসিক দৃঢ়তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। মন লড়ে গেলেও শরীর বিদ্রোহ করে। প্রবল প্রতিবাদের মধ্যে দেশে ফিরে মেরিরও তাই হল। ফেরার সঙ্গে সঙ্গে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ভর্তি হতে হল হাসপাতালে।
দিনরাত তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে মেরির শরীরের অনেক কোষ তখন ক্ষতিগ্রস্থ, লিভার সাংঘাতিকভাবে ড্যামেজড। মিডিয়াকে এড়াতে অন্য নামে কেবিন বুক করতে হল।
কিন্তু সাংবাদিকরা আর দেশের জনতা তাতেও তাঁকে রেহাই দিল না। রটিয়ে দেওয়া হল, মেরি আসলে পলের অবৈধ সন্তানের মা হতে যাচ্ছিলেন, তাই গর্ভপাত করাতে গোপনে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। ছি ছি কী লজ্জা!
এতকিছুর পরও ভগ্নদেহে বাড়ি ফিরলেন মেরি। ধীরে ধীরে ফিরলেন কাজেও। রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের ভবন তৈরি করা শুরু করলেন। ধীরে ধীরে যেতে লাগলেন নানা দেশের কনফারেন্সে। চলতে লাগল তাঁকে নিয়ে আজকের ভাষায় ট্রোলও।
তারপর শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যে ফরাসী জনতা তাঁকে ছিঁড়ে খেয়েছে, সেই ফরাসী সেনাদেরই সেবাশুশ্রূষায় আঠেরোটি ভ্যানে এক্স রে মেশিন নিয়ে মেরি পড়ে রইলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। এ মাথা থেকে ও মাথা ছুটোছুটি করে দ্রুত রেডিওঅ্যাক্টিভ এক্স রে মেশিনে নির্ণয় করতে লাগলেন অসুখ, বাঁচাতে লাগলেন তাঁদের। কিন্তু এই লাগাতার নোংরা আক্রমণে ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ডভাবে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ছিলেন তিনি। একেই ভীষণ দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন, ছোট থেকে অকল্পনীয় সংগ্রাম করে উঠে এসেছিলেন। তারপর আর শরীর নিতে পারছিল না।
মেরির যুদ্ধক্ষেত্রে অত কর্মকাণ্ডে মিডিয়া একটু থমকাল বটে, কিন্তু থামল না। বলল, "লোকের কাছে ভাল সাজতে চাইছে এসব করে।"
এরপর যতদিন বেঁচেছিলেন, মনের দিক থেকে কোনদিনও স্বাভাবিক হতে পারেননি মেরি কুরি। মৃত্যুর আগে মেয়েদের বলে গিয়েছিলেন, তাঁকে যেন কবর দেওয়া হয় স্বামী পিয়েরের কবরের ওপরেই। তাই হয়েছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার, পল ও মেরির প্রেম পূর্ণতা পায়নি, কিন্তু কয়েকদশক পরে পলের নাতি মাইকেল ও মেরি কুরির নাতনি হেলেন একে অন্যকে বিবাহ করে সুখী দম্পতি হয়েছিলেন।
৭ই নভেম্বর সেই বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক মাদাম মেরি কুরির জন্মদিন। তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের বিজ্ঞান। চারিত্রিক দোষে প্রত্যক্ষভাবে দুষ্ট কত পুরুষ তাঁর কর্মজগতে নন্দিতই হয়েছেন। হয়ে চলেন। ক্রেডিটও নেন কেউ কেউ। অথচ ভাবতেও আশ্চর্য লাগে, এত বড় বিজ্ঞানীও মহিলা হওয়ার 'অপরাধ' এ কতবড় যাতনা সহ্য করেছেন।
সব ধর্মগ্রন্থেই চরিত্রহীনা নারীর জন্য কড়া শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু চরিত্রহীন পুরুষের জন্য নেই যে!
মাদাম মেরি কুরি আপনি লড়াইয়ের দ্বিতীয় নাম। তখনকার পুরুষ শাসিত সমাজে এক মেধাবিনীর রাজত্ব করার দ্যোতক। আপনি যদি অতবছর আগে পেরে থাকেন, আমরা তার ১ শতাংশ হলেও পারব।
তাঁর কাজ, প্রথম মানুষ হিসেবে দুবার নোবেলজয়ের কৃতিত্বই রয়ে গেছে ইতিহাসে, সেইসব কুৎসা, আঘাত, গুজব মুছে গেছে, ঝরে গেছে আবর্জনাময় মেদের মত। এটাই হয়। আঘাত পেলেও থামবেন না, জানবেন, আপনার কাজগুলো ঠিক রয়ে যাবে। বাকি সব হারিয়ে যাবে।
তথ্যসূত্রঃ
১. Marie Curie: the woman who changed the course of science, Philip Steele.
২. Madame Curie: A Biography, Eve Courie.
৩. Marie Curie: A life, Susan Quinn.
No comments:
Post a Comment