এক রাজা ছিলেন, তার রাজ্যে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ কাজের আশায় আসত। একদিন সকালে দরবারে অচেনা এক লোক এসে মাথা নোয়াল, “মহারাজ, আমি আপনার সেবায় নিয়োজিত হতে চাই।”
রাজা মুচকি হেসে বললেন, “তোমার যোগ্যতা কি?”
লোকটি শান্ত গলায় বলল, “আমি প্রাণীদের স্বভাব দেখে তার গোপন কথা বুঝতে পারি।”
রাজা কৌতূহলী হয়ে তার দিকে তাকালেন। যদিও কিছু না বলে রাজপ্রাসাদের সবচেয়ে প্রিয় ঘোড়ার আস্তাবলের দায়িত্ব তাকে দিলেন।
কিছুদিন পরে রাজা তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার সবচেয়ে দামি ঘোড়াটিকে কেমন দেখছ?”
লোকটি উত্তর দিল, “মহারাজ, ঘোড়াটি বাহ্যিকভাবে খুব সুন্দর, কিন্তু এটি জাত ঘোড়া নয়।”
রাজার মুখে বিস্ময়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের অভিজ্ঞ ঘোড়সওয়ারকে ডেকে পাঠালেন। ঘোড়সওয়ার মাথা নিচু করে বলল, “ঘোড়াটি খাঁটি জাতের, তবে জন্মের পরপরই তার মা মারা যায়। ছোটবেলায় সে গরুর দুধ খেয়ে বড় হয়েছে।”
রাজা তখন লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কীভাবে এটা বুঝলে?”
লোকটি বিনম্রভাবে বলল, “মহারাজ, ঘোড়াটি যখন ঘাস খায়, তখন গরুর মতো মাথা নিচু করে খায়। কিন্তু জাত ঘোড়া মুখে ঘাস নেওয়ার পর মাথা উঁচু করে রাখে।”
রাজা তার প্রখর বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে প্রচুর পুরস্কার দিলেন। গরু, ছাগল, শস্য, ঘি সব পাঠিয়ে দিলেন তার ঘরে।
একদিন রাজা তাকে ডেকে বললেন, “তুমি এখন থেকে রাণীর প্রাসাদে কাজ করবে।”
কয়েকদিন পরে রাজা জানতে চাইলেন, “আমার রাণী সম্পর্কে তোমার মত কি?”
লোকটি শান্তভাবে বলল, “রাণী খুবই মার্জিত, তার আচরণও রাজকীয়, কিন্তু তিনি জন্মসূত্রে রাণী নন।”
রাজা হতভম্ব হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার শাশুড়িকে ডেকে আনলেন।
শাশুড়ি কিছুটা ধরা গলায় বললেন, “এটা সত্যি, জন্মের সময় আমি আমার আমাদের মেয়েকে হারিয়েছিলাম। তাই সম্পর্ক বাঁচাতে স্বামীর অজান্তে আমি অন্যের কন্যাকে নিজের মেয়ে হিসেবে বড় করেছি।”
রাজা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি এটা কীভাবে বুঝতে পারলে?”
লোকটি বলল, “মহারাজ, আসল রাজকন্যারা তাদের ভৃত্যদের সঙ্গে সৌজন্য সহকারে কথা বলে। কিন্তু আপনার রাণী ভৃত্যদের সঙ্গে এমন আচরণ করেন, যেন ওরা কেবল তার আদেশ পালনের জন্য।”
রাজা আবারও মুগ্ধ হলেন। তিনি তাকে আবারও প্রচুর পুরস্কার দিলেন: গরু, ছাগল, শস্য, ঘি ইত্যাদি এবং এবার তাকে নিজের দরবারে স্থায়ী চাকরিতে নিযুক্ত করলেন।
কয়েক মাস পর, রাজা একদিন মুচকি হেসে বললেন, “তুমি তো সবাইকে চিনে ফেলছ, এবার বলো, আমার সম্পর্কে কি ভাবো?”
লোকটি চুপ করে রইল। তারপর বলল, “মহারাজ, আপনি যদি প্রতিশ্রুতি দেন যে আমার প্রাণ নেবেন না, তবে আমি বলি।”
রাজা রাজকীয় গম্ভীরতায় বললেন, “প্রতিশ্রুতি দিলাম।”
লোকটি মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি রাজার সন্তান নন, আর আপনার আচরণেও রাজরক্তের ছাপ নেই।”
রাজার চোখ রাগে লাল হয়ে গেল, কিন্তু প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ল। তিনি সরাসরি নিজের মায়ের প্রাসাদে গেলেন।
রানীমা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁ, এটা সত্যি। আমরা সন্তানহীন ছিলাম, তাই এক রাখালের শিশুকে দত্তক নিয়েছিলাম, সেটাই তুমি।”
রাজা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, যেন পৃথিবীটা এক লহমায় পৃথিবী বদলে গেল।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে তিনি আবার লোকটিকে ডেকে বললেন, “তুমি কীভাবে টের পেলে?”
লোকটি মৃদু হেসে বলল, “মহারাজ, রাজারা যখন পুরস্কার দেন, তখন তারা হীরা জহরত, মণি মাণিক্য বা সোনাদানা দেন। কিন্তু আপনি দেন ঘি, গরু, ছাগল, শস্য — সেটা রাখালের স্বভাব।”
তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “মহারাজ, একজন মানুষের আসল পরিচয় তার মুখে নয়, তার আচরণে লুকিয়ে থাকে। পদ-মর্যাদা বা ধনসম্পদ যতই হোক না কেন, মানুষকে মানুষ করে তোলে তার ব্যবহার। আপনি একজন ভালো মানুষ আর এটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
রাজা খুশি হয়ে তার কর্মচারীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
Comments
Post a Comment