হিটলারের প্রেম কাহিনী ও বিয়ে...।
পৃথিবী প্রেমময়, এই পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে আছে নানা ধরনের প্রেমের কাহিনী। যে কাহিনীগুলো হৃদয় কে দোলা দেয়। লায়লা- মজনু, হির- রঞ্জা, রোমিও- জুলিয়েট সবার মনে দাগ কেটে গেছে। প্রেমিক বলতেই আমরা বুঝি নরম মনের মিষ্টি স্বভাবের কেউ, কিন্তু গোটা বিশ্বের আতঙ্ক তথা নাৎসি বাহিনীর লিডার স্বৈরাচারী হিটলারের জীবনেও প্রেম ছিল সেটা ভাবতে অবাকই লাগে।
এই ভয়ঙ্কর মানুষটির প্রেমে পড়েছিল একাধিক নারী। যাদের মধ্যে ইভা ব্রাউন ছিলেন অন্যতম।
যখন ইভার সঙ্গে হিটলারের পরিচয় হয়েছিল তখন তার বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছর এবং হিটলার ছিলেন চল্লিশ বছরের যুবক । সেসময় ইভা একজন ফটোগ্রাফারের সহকারি ও মডেল হিসেবে কাজ করতেন। প্রথম দেখার সময় হিটলারের আসল পরিচয় জানতেন না ইভা। তবুও প্রথম দেখায় প্রেমে পড়েছিলেন হিটলারের। আর হিটলার ও তার চোখের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। এরপর আস্তে আস্তে হিটলারের সঙ্গে ইভার দেখা-সাক্ষাৎ বাড়তে থাকে। এবং অচিরেই তারা গভীর প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন। সে সময় অবশ্য হিটলার স্বৈরাচারী নেতা হয়ে ওঠেননি।
অনেকের মতে ইভার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর আগে হিটলার তার সৎ বোন এঞ্জেলার মেয়ে গেলি রোবালের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। লুডউইগ ম্যাক্সিমিলান ইউনিভার্সিটি তে মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা করার সময় হিটলারের বাড়িতে থাকা শুরু করেছিলেন গেলি। আর সেই সময়ই হিটলার গেলির ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে শুরু করেন এবং তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। কিন্তু তরুণী গেলি হিটলারের ব্যক্তিগত গাড়িচালক এমিল মরিসের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আর এটা জানতে পেরে হিটলার মরিসকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন এবং এরপর থেকে গেলি যেখানেই যেতেন হিটলার তার সঙ্গে একজন কে পাঠিয়ে দিতেন। জ্ঞানীকে একপ্রকার নিজের নজরবন্দি করে রেখেছিলেন হিটলার। এরপর গেলি ভিয়েনায় চলে যেতে চেয়েছিলে, কিন্তু হিটলার তাতেও বাধ সেধেছিলেন। ১৯৩১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর হিটলার আর গেলির মধ্যে চরম অশান্তি হয় এই ভিয়েনায় যাওয়া নিয়ে আর তারপর মাত্র তেইশ বছর বয়সে গেলি রোবাল হিটলারের রাইফেল দিয়ে নিজের বুকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। তবে হিটলারের সাথে গেলির ঘনিষ্ঠতা কতটুকু ছিল বা তার সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্ক ছিল কিনা সেটা নিয়ে একেক জন ইতিহাসবিদ এক এক রকম কথা বলে থাকেন। তবে ঐতিহাসিকদের মতামত অনুযায়ী হয় গেলি হিটলারের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন অথবা হিটলারের নজরবন্দি দশা থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলেন এই দুটি কারণের একটি জন্যই গেলি এত কম বয়সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে ছিলেন। গেলির আত্মহত্যা করার পর হিটলার খুব ভেঙ্গে পড়েছিলেন, আর এই সময়ে তার জীবনে উপস্থিত হন ইভা ব্রাউন।
তবে ইভাকে নিয়ে প্রথমদিকে হিটলারের একটু সন্দেহ ছিল, তিনি মনে করেছিলেন ইভার দেহে ইহুদির রক্ত আছে, আর এর ফলে তিনি গোয়েন্দার সাহায্য নিয়ে ইভার পরিবারের সমস্ত বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন। এবং জানতে পারেন যে ইভা এরিয়ান অর্থাৎ আর্য রক্তের অধিকারিনী ।
ইহুদিদের ঘৃণা করার পেছনেও আছে এক প্রেমের গল্প। ১৯০৬ সাল, ভিয়েনার রাস্তার ধারে বসে ছবি আঁকতেন এক শিল্পী। তখন সেই শিল্পীর বয়স ছিল মাত্র আঠারো বছর, একদিন সেই শিল্পীর কাছে ছবি আঁকাতে এলো এক পরমা সুন্দরী কন্যা। ষোলো বছরের মেয়েটিকে দেখেই একতরফা প্রেমে পড়ে যায় সেই শিল্পী। এরপর থেকে মেয়েটির বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে সেই শিল্পী। সুযোগ বুঝে মেয়েটিকে তার ভালোবাসার কথাও বলে ফেলে সে, কিন্তু মেয়েটি কোন উত্তর দেয় না। ভিয়েনার সেই মেয়েটির নাম ছিল স্টিফানি আইজাক, যে ছিল একজন ইহুদি,বড় ব্যবসায়ী বাবার কন্যা। আর শিল্পী ছেলেটির নাম ছিল এডলফ হিটলার। সেই সময় হিটলারের স্বপ্ন ছিল একজন বড় চিত্রশিল্পী হওয়ার। হিটলার স্টিফানি কে তার মনের কথা বলার পরেও যখন কোন উত্তর পাননি তখন সে মাঝেমধ্যেই তার প্রিয় পোষা কুকুরের মুখে প্রেমপত্র দিয়ে তাকে স্টিফানি দের প্রাসাদ সম বাড়ির গেটের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিতেন আর এই ব্যাপারটা নজরে পড়ে স্টিফানির বাড়ির লোকের । একটা চালচুলোহীন ছেলে, যে ইহুদি নয়,যার ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই, সেই ছেলেকে মেয়ের চারপাশে ঘুরঘুর করার বিষয় টা মেনে নেননি স্টিফানির বাবা, এবং তিনি তখন হিটলার কে তার বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করতে বারণ করে দেন। কিন্তু আঠেরো বছর বয়েস টা নিষেধ না মানার বয়েস, আর তাই বারণ সর্তেও মেয়েটিকে বারবার কুকুরের মুখ দিয়ে প্রেমপত্র পাঠাতেন হিটলার। এরকমই একদিন তিনি কুকুরের মুখ দিয়ে স্টিফানি র বাড়ির মধ্যে প্রেমপত্র পাঠান, কিন্তু রাত পার হয়ে যায় কুকুরটি আর ফিরে আসে না। পরদিন সকাল বেলায় কুকুরটির মৃতদেহ স্টিফানির বাড়ির সামনে দেখতে পান হিটলার। কুকুরটি তার খুব প্রিয় ছিল। কারণ এটি তার মার দেওয়া শেষ উপহার ছিল। কুকুরটির মারা যাওয়ার পর হিটলার আর কোনদিন স্টিফানির বাড়ির সামনে যাননি।
ইতিহাসবিদরা মনে করেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার তেষট্টি লাখ ইহুদিকে প্রানে মেরে ফেলেছিলেন যার পেছনে হয়তো স্টিফানির প্রতি প্রেম মিশ্রিত ঘৃণাই দায়ী।
স্টিফানির পরেই সম্ভবত হিটলারের যে নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ রমণী। তার নাম ছিল উইনিফ্রেড ওয়াগনার।১৯২০ সালের প্রথম দিকে উইনিফ্রেডের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনা হয় হিটলারের। পরিচিত মহলে সবাই মনে করতেন যে হিটলার হয়তো এবার বিধবা উইনিফ্রেড এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর হয়নি। ইতিহাসবিদদের মত অনুসারে ইহুদিদের প্রতি হিটলারের মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি একদমই পছন্দ ছিল না উইনিফ্রেডের। তবে এতকিছুর পরেও তিনি ছিলেন হিটলারের খুব কাছের বন্ধু।
ইভা ব্রাউনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর আগে পরে একাধিক নারীর সাথে হিটলারের সম্পর্কের কথা শোনা যায়। যাদের মধ্যে অন্যতম মাগদা গোয়েবলস। এই মাগদা ছিলেন ন্যান্সি বাহিনীর প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার জোসেফ গোয়েবলসের স্ত্রী। হিটলারের সঙ্গে মাগদার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জোসেফ জানতেন। হিটলারের মৃত্যুর পর মাগদা আর জোসেফও আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন, তবে নিজেদের মৃত্যুর আগে তাদের ছয় সন্তানকে একে একে খুন করেছিলেন তিনি। প্রথমে বাচ্চাদের মরফিন প্রয়োগ করে ঘুম পাড়ান তারপরে সবার মুখে সায়ানাইড ট্যাবলেট রেখে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
হিটলারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িত ছিলেন আরো একজন নারী। তার নাম ছিল এমি গোয়েরিং। এমি একজন জার্মান অভিনেত্রী ছিলেন এবং নাৎসি লুফটওয়াফে বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হারম্যান গোয়েরিং এর স্ত্রী ছিলেন তিনি। এমির হিটলারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানতেন ইভা ব্রাউন। আর সেই কারণেই এমিকে তিনি পছন্দ করতেন না।
এছাড়াও তৎকালীন জনপ্রিয় নায়িকা রেনাটে মুলারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন হিটলার। এই নায়িকাও আত্মহত্যা করেছিলেন। ইভা ব্রাউন এই সম্পর্কের কথাও জানতেন।
এত কিছু দেখা বা শোনার পরেও ইভা ব্রাউন কোন দিনও হিটলারের সঙ্গ ছাড়েননি।তবে হিটলারের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন মান অভিমানের কারনে দুবার তিনি আত্মহত্যার করতে গিয়েছিলেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁচে যান। এই ঘটনার পরে হিটলার ইভাকে কথা দিয়েছিলেন তিনি তাঁকে সময় দেবেন।
কিন্তু হিটলারের সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্বেও ইভা ব্রাউনের কথা জার্মানের সাধারন মানুষ জন জানতেন না। ইভার অধিকাংশ সময় কাটতো ওবারসালজবার্গে। এখানে হিটলারের ব্যক্তিগত সময় কাটানো অর্থাৎ অবসর সময় যাপন করার জায়গা ছিলো আর সেখানেই থাকতেন ইভা ব্রাউন। ইভা খুব একটা জনসম্মুখেও আসতেন না। প্রথমদিকে ইভার সঙ্গে হিটলারের সম্পর্ক মেনে নেননি ইভার পরিবার। ইভার ডায়রি থেকে জানা যায় যে ইভাকে মদ্যপান এবং ধূমপান করতে দিতেন না হিটলার, সাধারণ জনগণের সামনে বেরোনো, তাদের সঙ্গে আলাপচারিতা, পার্টীতে নাচ করা সবকিছুই ইভার বারণ ছিল। আসলে হিটলারই তাদের সম্পর্কে সবকিছু ঠিক করতেন, এমনকি তারা কখন ঘনিষ্ঠ হবেন তাও নির্ভর করত হিটলারের মর্জির ওপর।
হিটলারকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন ইভা ব্রাউন। আর তাই সবকিছু মেনে নিয়েছিলেন। তিনি হিটলারকে কোনোদিনই ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেননি। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানির হার নিশ্চিত সেই সময় নাৎসি নেতারা জার্মানি ছেড়ে পালিয়ে গেলেও ইভা ব্রাউন কোথাও পালিয়ে যাননি।এরপরে হিটলারের শেষ ভরসা স্তেইনের সেনাবাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং তার বেশিরভাগ সঙ্গী মিত্র বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে যায়। এই সময় বার্লিন শহরে মাটির নিচে ফিউরার বাংকারে ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে নিয়ে হিটলার লুকিয়ে ছিলেন।
এত বছর ধরে একত্রে বসবাস করলেও হিটলার আর ইভা ব্রাউনের বিবাহ সম্পন্ন হয়নি। তবে ইভা ব্রাউন স্বপ্ন দেখতেন হিটলারকে বিয়ে করার। আর জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ইভা ব্রাউনের।
১৯৪৫ সালের ২৮শে এপ্রিল, মধ্যরাতে মাত্র কয়েক জনের উপস্থিতিতে রেজিস্ট্রি বিবাহ সম্পন্ন হয় এডলফ হিটলার আর তার বহুদিনের সঙ্গী ইভা ব্রাউনের। রেজিস্ট্রেশন করার সময় ইভা তার নামের পাশে ব্রাউন লিখতে গিয়েও সেটা কেটে হিটলার লেখেন। এরপরে ৩০শে এপ্রিল দুপুরে মাত্র কয়েক ঘণ্টার বিবাহিত দম্পতি হিটলার আর ইভা ঘনিষ্ঠজনদের বিদায় জানান। এরপর সায়ানাইড খেয়ে ইভা আত্মহত্যা করেন আর হিটলার সায়ানাইড খাওয়ার সাথে সাথে নিজের মাথায় গুলি করে মৃত্যুবরণ করেন। হিটলারের শেষ ইচ্ছাপত্র অনুযায়ী তার ঘনিষ্ঠরা দুটি দেহ জ্বালিয়ে দেন।
আর এখানেই শেষ হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খলনায়কের প্রেমের কাহিনী।
No comments:
Post a Comment