পৃথিবীতে সৌরশক্তির ব্যবহার
পৃথিবীর মহাসাগর, বায়ুমণ্ডল, ভূমি এবং জীবমণ্ডলের জন্য সূর্য প্রধান শক্তির উৎস। এক বছরের হিসাব করলে, পৃথিবীর প্রতি বর্গমিটারে সৌরশক্তি পৌঁছায় গড়ে প্রায় ৩৪২ ওয়াট।
এটি বিপুল পরিমাণ শক্তি—সঠিকভাবে বললে, ৪৪ কোয়াড্রিলিয়ন (৪.৪x১০১৬) ওয়াট শক্তি। এর তুলনায় একটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করে প্রায় ১ বিলিয়ন (১x১০৯) ওয়াট। সূর্য থেকে আসা শক্তির পরিমাণের সমান হতে গেলে, এরকম ৪৪ মিলিয়ন সংখ্যক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজন হবে।
সূর্য হল পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্র। এমনকি ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার (বা ৯৩ মিলিয়ন মাইল) দূর থেকেও সূর্য তার মহাকর্ষীয় টানের মাধ্যমে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে নিজ কক্ষপথে ধরে রাখে। সূর্য থেকে আসা আলো ও তাপ বা সৌরশক্তি বিকিরণের কারণেই পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে।
বৃদ্ধির জন্য উদ্ভিদের সূর্যালোক প্রয়োজন। আবার মানুষসহ অন্যান্য প্রাণির খাদ্য ও অক্সিজেনের জন্য উদ্ভিদ প্রয়োজন। সূর্যের তাপ না থাকলে পৃথিবী ঠাণ্ডায় জমে যেত—পানি পরিবহনের জন্য কোনো বাতাস, সমুদ্র স্রোত বা মেঘ থাকত না।
সূর্যের মতই সৌরশক্তিও প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর ধরে আছে। মানবজাতি অত প্রাচীন না হলেও, হাজার হাজার বছর ধরে সৌরশক্তিকে তারা বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করে আসছে।
.
# কৃষিতে সৌরশক্তি
কৃষিতে সৌরশক্তি অপরিহার্য—চাষাবাদ থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদন এবং পশুপালন করা পর্যন্ত।
প্রায় ১০,০০০ বছর আগে বিকাশ লাভ করা কৃষি, মানব সভ্যতার উত্থানে মূল ভূমিকা পালন করেছিল। একই ভূমিতে ঋতুভেদে ভিন্ন ফসল চাষ করার মত সূর্য ভিত্তিক কৌশলগুলি সাহায্য করেছিল আরো বেশি ফসল ফলাতে। সূর্যের আলো ও বাতাসে খাবার শুকিয়ে ফসলকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করা হত। এই অতিরিক্ত খাদ্য সম্ভব করে তুলেছিল ঘনবসতি এবং সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠা।
.
# সূর্যের আলো ও তাপ সংগ্রহ
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রাচীন সভ্যতাগুলি, তাপ ও আলো সংগ্রহের জন্য বাসস্থান বা বাড়িঘরগুলিকে দক্ষিণমুখী করে নির্মাণ করত। একই কারণে তারা জানালা ও স্কাইলাইট ব্যবহার করত, যেন একই সাথে ঘরে বাতাস চলাচলও নিশ্চিত করা যায়। এসবই সূর্য কেন্দ্রিক স্থাপত্যের মূল উপাদান।
অন্যান্য কৌশলের মধ্যে রয়েছে ছায়ার ব্যবহার এবং তাপ ধরে রাখতে সক্ষম এমন নির্মাণ সামগ্রী, যেমন পাথর ও কংক্রিট নির্বাচন করা।
.
# গ্রিনহাউস
গ্রিনহাউস সৌরশক্তির ব্যবহারের আরো একটি প্রাচীন নিদর্শন। সূর্যের আলোকে তাপে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে গ্রিনাহাউস এই মুহূর্তে প্রাকৃতিক ভাবে সম্ভব নয় এমন ফসলের উৎপাদন সম্ভব করে তোলে। অথাৎ, সূর্যালোকের সাহায্যে ভিন্ন ঋতুতে এবং অনুপযোগী জলবায়ুতেও গাছপালা জন্মানো সম্ভব হয় গ্রিনহাউসের মাধ্যমে।
সর্বপ্রথম গ্রিনহাউসের একটি তৈরি হয় প্রায় ৩০ খ্রিস্টাব্দে, সেটিও গ্লাস বা কাচ আবিষ্কারের আগে। তাই একদম প্রাথমিক গ্রিনহাউস নির্মাণে কাচ নয়, বরং মাইকা নামের এক ধরনের চিকন খনিজ পদার্থের স্বচ্ছ পাত ব্যবহার করা হয়েছিল। তৈরি করা হয়েছিল রোমান সম্রাট টিবেরিয়াসের জন্য, যিনি সারা বছরই শসা খাওয়ার সুযোগ থাকুক এমনটি চাইতেন। ফসলের ধরন ও পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য অনেক উন্নতি সাধন হলেও, আজও গ্রিনহাউসের মূলনীতি একই আছে।
.
# রান্না ও জীবাণু মুক্তকরণে সৌরশক্তি
প্রথম সোলার বক্স কুকার তৈরি করেছিলেন সুইস পদার্থবিজ্ঞানী হোরাস ডি সস্যুর, ১৭৬৭ সালে। কুকারটির তাপমাত্রা ৮৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত গিয়েছিল, ব্যবহৃত হত ফল রান্নায়। এখন রান্না, শুকানো এবং পাস্তুরিত করার কাজে বিভিন্ন ধরনের সোলার কুকার ব্যবহার করা হয়।
পাস্তুরিতকরণ হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে খাবারের মধ্যে থাকা ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করা হয়। যেহেতু এগুলিতে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহৃত হয় না তাই এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ, এতে কোনো দূষণ হয় না বা গাছপালা ধ্বংসের কারণ ঘটে না।
বিশ্বের অনেক অঞ্চলে সৌর কুকারের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। শুধু ভারতেই প্রায় ৫ লক্ষ সোলার কুকার ব্যবহৃত হয়। দেশটিতে বিশ্বের দুটি বৃহত্তম সৌর রান্নার ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে প্রতিদিন ২৫,০০০ মানুষের খাবার প্রস্তুত করা যায়। নিকারাগুয়াতে, একটি বিশেষ ধরনের সোলার কুকার ব্যবহার করে ক্লিনিকগুলিতে চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করা হয়।
.
# পানি গরম করার কাজে সৌরশক্তি
পানি গরম করতেও সৌরশক্তি ব্যবহার করা যায়। ১৮০০ শতকের শেষের দিকে আবিষ্কৃত এই সোলার ওয়াটার হিটার কাঠ বা কয়লা পোড়ানো চুলার চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ছিল, কারণ এটি পরিষ্কার করার ঝামেলা ছিল না এবং চালাতেও খরচ খরচ হত কম। ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, আরিজোনা সহ রৌদ্রোজ্জ্বল এলাকাগুলিতে অবস্থিত আমেরিকান বাড়ির জন্য এগুলি খুবই জনপ্রিয় ছিল। ১৯০০ এর দশকের গোড়ার দিকে কম খরচের তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস এসে সোলার ওয়াটার সিস্টেমের জায়গা নিয়ে নেয়।
আর এখন এগুলি শুধু যে পাওয়া যাচ্ছে তা’ই না, বরং চীন, গ্রীস এবং জাপান সহ কিছু দেশে সোলার ওয়াটার সিস্টেম ব্যবহার করাটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। অস্ট্রেলিয়া, ইসরায়েল এবং স্পেনে নতুন নির্মাণে এগুলি ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।
.
# পানযোগ্য পানি প্রস্তুতিতে সৌরশক্তি
পানি গরম করার পাশাপাশি, পানযোগ্য বা খাওয়ার উপযোগী পানি প্রস্তুতেও সৌরশক্তি ব্যবহৃত হয়। সৌর জীবাণুমুক্তকরণ (SODIS) এরকম একটি পদ্ধতি। ১৯৮০-এর দশকে উদ্ভাবিত এই প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিকের সোডা বোতল পানিতে ভরে কয়েক ঘণ্টা সূর্যের আলোতে রেখে দেয়া হত। এতে পানিতে থাকা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটোজোয়া ধ্বংস হয়। বিশ্বের ২৮টি উন্নয়নশীল দেশের প্রায় বিশ লক্ষেরও বেশি মানুষ দৈনিক খাবার পানির জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করে। উল্লেখ্য, SODIS-এর মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করা পানি ২৪ ঘণ্টার জন্য পানযোগ্য থাকে।
.
# সৌর বিদ্যুৎ
সূর্যের আলো’কে বিদ্যুতে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া—সৌর প্রযুক্তির আরও একটি প্রয়োগ। বিভিন্নভাবে এটি করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত দুটি পদ্ধতি হল ফটোভোল্টাইক (সৌর কোষ) এবং কনসেনট্রেটিং সোলার পাওয়ার।
সোলার সেল বা সৌরকোষ সূর্যের আলোকে সরাসরি বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে। প্রতিটি কোষ যে পরিমাণ শক্তি তৈরি করে তা অত্যন্ত কম। তাই, বাড়ির ছাদে যেমন প্যানেল লাগানো থাকে, সেভাবে পর্যাপ্ত শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রচুর সংখ্যক কোষকে একসাথে রাখতে হয়।
প্রথম সৌরকোষটি তৈরি করা হয়েছিল ১৮৮০ সালে। সৌরকোষের সবচেয়ে প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার ছিল মার্কিন স্যাটেলাইট ভ্যানগার্ড-১ এ, যা ১৯৫৮ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল।
সৌরকোষ দ্বারা চালিত একটি রেডিও ট্রান্সমিটার প্রায় ৭ বছর ধরে চলেছিল, প্রচলিত ব্যাটারির ব্যবহারে যেটি মাত্র ২০ দিন চলতে পারত। তখন থেকেই টেলিকমিউনিকেশন শিল্পে ব্যবহৃত স্যাটেলাইট সহ সকল কৃত্রিম উপগ্রহের জন্য সৌরকোষই প্রধান শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পৃথিবীতে ক্যালকুলেটর এবং ঘড়ি থেকে শুরু করে বাড়ি, বাণিজ্যিক ভবন এমনকি স্টেডিয়ামেও সৌরকোষ ব্যবহৃত হয়। ২০০৯ সালে ওয়ার্ল্ড গেমস আয়োজনের জন্য নির্মিত তাইওয়ানের কাওশিয়াং ওয়ার্ল্ড স্টেডিয়ামের ছাদে ৮,৮০০-এরও বেশি সৌর প্যানেল রয়েছে। স্টেডিয়াম যখন ব্যবহার করা হয় না, সৌর প্যানেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আশেপাশের এলাকার ৮০ শতাংশের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে পারে।
.
# কিছু চ্যালেঞ্জ
সৌরশক্তি ব্যবহারের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথমত, এটি অনিয়মিত, অর্থাৎ একটানা প্রবহমান নয়। যখন সূর্যালোক থাকে না, যেমন রাতে, তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। একটানা বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বায়ুশক্তির মত কোনো শক্তির উৎস অথবা শক্তি সঞ্চয় করে রাখার প্রয়োজন পড়ে।
দ্বিতীয়ত, ফটোভোল্টাইক এবং ঘনীভূত সৌরশক্তি যেখানেই ব্যবহার করা সম্ভব হোক না কেন, এর সরঞ্জাম অনেক বেশি জায়গা দখল করে। বিদ্যমান কোনো স্থাপনা বাদে, অন্যত্র বসালে উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণীকে সরিয়ে জায়গা করে দিতে হবে, যা বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এছাড়া সৌরশক্তি সংগ্রহ, রূপান্তর এবং সঞ্চয় করতে খরচ অনেক বেশি পড়ে। তবে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে খরচও কমে আসবে।
কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মত জীবাশ্ম জ্বালানি বর্তমানে আমাদের বেশিরভাগ বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক শক্তির যোগান দেয়। এগুলি একইসাথে আমাদের দূষণেরও প্রায় সবটাই তৈরি করে। তারওপর এগুলি অনবায়নযোগ্য উৎস, অর্থাৎ এর সরবরাহ সীমিত।
অন্যদিকে, সূর্য প্রচুর পরিমাণে ও বিনামূল্যে, পরিচ্ছন্ন শক্তি দেয়। এমনকি, আমাদের ব্যবহার ক্ষমতার চাইতেও অনেক বেশি শক্তি প্রদান করে। এখন প্রশ্নটা হল কীভাবে এবং কখন আমরা এর পরিপূর্ণ সুবিধা নিতে পারব।
#সৌরশক্তি #সূর্য #শক্তি
Collected
No comments:
Post a Comment