Wednesday, April 3, 2024

গ্রিনহাউস ইফেক্ট কী? গ্রিনহাউস ইফেক্ট মানেই কি ভয়ঙ্কর কিছু?

গ্রিনহাউস ইফেক্ট কী? গ্রিনহাউস ইফেক্ট মানেই কি ভয়ঙ্কর কিছু?

আমরা প্রায়ই 'গ্রিনহাউস ইফেক্ট' শব্দটি বিশ্ব উষ্ণায়নের নেতিবাচক প্রসঙ্গ উঠলে শুনি–এর কারণেই পৃথিবীর হিমবাহগুলি গলে যাচ্ছে এবং আবহাওয়ায় বিপজ্জনক পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু গ্রিনহাউস ইফেক্ট আসলে নিজে ভয়ঙ্কর কিছু নয়, বরং পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক অংশ।

গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণেই পৃথিবী, প্রাণের টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট উষ্ণ থাকতে পারে। যদি পৃথিবীতে গ্রিনহাউস ইফেক্ট না থাকত, আমাদের গ্রহ সম্ভবত মঙ্গল গ্রহের মত হয়ে উঠত। মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল পর্যাপ্ত ঘন নয়, যার ফলে তাপকে গ্রহে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। তাই সেখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা।

তাহলে, গ্রিনহাউস ইফেক্ট ঠিক কী?
.

# গ্রিনহাউস ইফেক্টের মূল বিষয়

প্রক্রিয়াটার নাম এসেছে গ্রিনহাউস থেকে। যেই প্রক্রিয়ায় গ্রিনহাউস, এর পরিবেশকে গাছপালা চাষাবাদের জন্য উষ্ণ রাখে, ঠিক একই প্রক্রিয়া পৃথিবীকেও জীবনধারণের জন্য উষ্ণ রাখে গ্রিনহাউস ইফেক্ট। 

আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে গ্রিনহাউস ইফেক্ট অনুভব করি, তার একটি উদাহরণ হল বেশ কিছুক্ষণ রোদে থাকার কারণে গাড়ির ভেতরের অংশ গরম হয়ে যাওয়া।

নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, গাড়ি বেশ কিছুক্ষণ রোদে থাকলে এর ভেতরটা বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি গরম লাগে। সূর্যের আলো গাড়ির জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সূর্যালোকের তাপের কিছু অংশ গাড়ির সিট, ড্যাশবোর্ড, কার্পেট ও ম্যাট শোষণ করে নেয়।

যখন এই বস্তুগুলি তাপ নির্গত করতে শুরু করে, সবটুকু তাপ জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায় না। এর কিছু অংশ আবার ভেতরেই প্রতিফলিত হয়, বা ফিরে আসে। গাড়ির সিট, ড্যাশবোর্ড, কার্পেট বা ম্যাট থেকে যে তাপ বের হয়, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য জানালা দিয়ে প্রবেশ করা সূর্যালোকের তরঙ্গদৈর্ঘ্য থেকে আলাদা। যার কারণে যখন এই বস্তুগুলি থেকে তাপ বের হওয়া শুরু করে, সব তাপ গাড়ির ভেতর থেকে বের হতে পারে না। জানালার কাচ এই আলাদা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তাপকে খুব বেশি পরিমাণে বের হতে দেয় না।

ফলে, গাড়ির ভেতরে যে পরিমাণ শক্তি ঢুকছে, তার চাইতে কম পরিমাণে গাড়ি থেকে বের হয়। যার ফলাফল, গাড়ির ভেতরে তাপ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া।

গাড়ি রোদে থাকার এই উদাহরণ ব্যবহার করে আমরা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকেও একটি বিশাল, গোলাকার গাড়ির জানালা হিসাবে ভাবতে পারি। গ্রিনহাউস ইফেক্ট ঠিক এভাবেই পৃথিবীকে তার চারপাশের পরিবেশ থেকে বেশি উষ্ণ করে রাখে।
.

# পৃথিবীর প্রাকৃতিক গ্রিনহাউস ইফেক্ট সম্পর্কে

সূর্যের আলো যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং পৃষ্ঠে এসে পড়ে, প্রায় ৭০% শক্তি গ্রহেই থেকে যায় এর ভূমি, মহাসাগর, গাছপালা এবং অন্যান্য উপাদান দ্বারা শোষিত হওয়ার মাধ্যমে। বাকি ৩০% মেঘ, তুষারক্ষেত্র (ইংরেজিতে ‘snow fields’, স্থায়ী তুষার ও বরফ দ্বারা আচ্ছাদিত অঞ্চল) এবং অন্যান্য প্রতিফলক পৃষ্ঠের দ্বারা মহাকাশে প্রতিফলিত হয়।

কিন্তু যেই ৭০% শক্তি পৃথিবীতে প্রবেশ করে, তা আবার চিরকাল পৃথিবীতে থাকে না (নইলে পৃথিবী একটি জ্বলন্ত আগুনের গোলায় পরিণত হত)। উদাহরণের গাড়ির সিট এবং ড্যাশবোর্ডের মতই, পৃথিবীর চারপাশে থাকা যে বস্তুসমূহ সূর্যের তাপ শোষণ করে, একসময় ঠিকই তার একটি অংশ ভিন্ন একটি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বিকিরণ করে বা বের করে দেয়।

এই শোষণ-বিকিরণ প্রক্রিয়া পৃথিবীকে বিকিরণীয় ভারসাম্যে রাখে: সূর্যের তাপ ক্রমাগত পৃথিবীতে আঘাত করে, উষ্ণ করে তোলে; উষ্ণ পৃথিবী আবার সেই তাপ কিছু অংশ মহাকাশে ফেরত পাঠায়, নিজেকে শীতল করে। পৃথিবী যত বেশি সৌর তাপ শোষণ করে, তত বেশি তাপ নির্গত করে।

পৃথিবীর নির্গত করা তাপের কিছু অংশ মহাকাশে পৌঁছায়। বাকি অংশ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন গ্যাস এবং জলীয় বাষ্পের মত উপাদানে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় পৃথিবীর দিকে ফিরে আসে। ঠিক যেমন গাড়ির ভেতরের তাপ, বের হওয়ার সময় গাড়ির জানালার কাচে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আবার ফিরে আসে।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দিয়ে যে তাপ বের হতে পারে না, তা পৃথিবীকে তার বাইরের পরিবেশ অর্থাৎ মহাশূন্যের চেয়ে বেশি উষ্ণ রাখে, যেহেতু বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে যতটা শক্তি পৃথিবীতে প্রবেশ করে, ততটা বের হতে পারে না। এটিই হল গ্রিনহাউস ইফেক্ট, যা পৃথিবীকে উষ্ণ রাখে।

সুতরাং গ্রিনহাউস ইফেক্ট আসলে একটি ভাল জিনিস। এবং বেশিরভাগ ভাল জিনিসের মতই, ভারসাম্য থাকলে গ্রিনহাউস ইফেক্টও খুবই ভাল।

কিন্তু গ্রিনহাউসকে আমরা এখন বেশিরভাগ সময়ই পরিবেশের ক্ষতির সাথে সম্পৃক্ত করি, কারণ শিল্প বিপ্লবের পর থেকে গ্রিনহাউস ইফেক্ট ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অত্যধিক তাপ আটকে ফেলছে।
.

# মঙ্গল গ্রহের গ্রিনহাউস-করণ

কিছু বিজ্ঞানী পরামর্শ দিয়েছেন, আমরা কিছু কারখানা মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়ে, মঙ্গলের পৃষ্ঠকে পুনর্বিন্যস্ত করতে পারি। এই কারখানাগুলি জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে দেবে। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করা যায়, তবে বায়ুমণ্ডল আরও ঘন হবে এবং মঙ্গল গ্রহ উত্তাপ ধরে রাখতে শুরু করবে। পরিবেশ হয়ে উঠবে গাছপালা বেঁচে থাকার সহায়ক।

একবার গাছপালা মঙ্গলজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে তারা অক্সিজেন তৈরি করা শুরু করবে। গ্রিনহাউসের কল্যাণে কয়েকশ বা হাজার বছর পর মঙ্গলে হয়ত এমন একটা পরিবেশ তৈরি হবে, যেখানে মানুষ সহজেই হেঁটে বেড়াতে পারবে।
.

# জীবাশ্ম জ্বালানীর দহন ও উন্নত গ্রিনহাউস প্রভাব

বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, বায়ুমণ্ডল না থাকলে পৃথিবীর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বর্তমানের তুলনায় প্রায় ৫৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) কম হত। এতে করে পৃথিবীর গড় পৃষ্ঠ তাপমাত্রা প্রায় ৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট (মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) হয়ে যেত। অন্যদিকে মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ৯.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (মাইনাস ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস)।

যার অর্থ, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং গ্রিনহাউস ইফেক্ট না থাকলে আমরা বেশ বিপদে পড়ে যেতাম। একইভাবে, অতিরিক্ত গ্রিনহাউস ইফেক্টও পৃথিবীতে বিধ্বংসী ফলাফল আনতে পারে। বায়ুমণ্ডলে তাপ-শোষকারী গ্যাসের পরিমাণ বেশি হলে, অতিরিক্ত বিকিরণ সেখানে আটকা পড়ে। তখন পৃথিবী থেকে বাড়তি তাপ বের হতে পারে না। আর পৃথিবী তখন তার আদর্শ তাপমাত্রার চেয়ে বেশি উষ্ণ হয়ে যায়।
 
আসলে, পৃথিবী নিজেকে শীতল রাখতে পর্যাপ্ত তাপ বের করতে পারছে না। ফলাফল হিসাবে যা ঘটছে, তাকে আমরা "বৈশ্বিক উষ্ণায়ন" বলে জানি। এটি মূলত একটি অনিয়ন্ত্রিত গ্রিনহাউস ইফেক্ট।

এই সমস্যার মূল কারণ, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি। জলীয় বাষ্পের পর, কার্বন ডাই অক্সাইডই সবচেয়ে বেশি মাত্রায় থাকা গ্রিনহাউস গ্যাস।

পৃথিবীতে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা মূলত গাছপালার ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে ভারসাম্যে রাখা হয়। কিন্তু মানুষ যখন থেকে ক্রমবর্ধমান হারে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনকারী জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো শুরু করেছে, এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে।

গাছপালা যে পরিমাণে ধারণ করতে পারে, তার চেয়ে অনেক বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড আমরা বায়ুমণ্ডলে মিশিয়ে দিচ্ছি (তার ওপরে বন উজাড়ের কারণে আরো বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে)। 

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে শিল্প বিপ্লবের আগে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব ছিল প্রতি মিলিয়নে প্রায় ২৮০ ভাগ (পিপিএম)। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সেই সংখ্যা ছিল ৩৩০ পিপিএম। আর ২০২৩ এ সেই সংখ্যা হয়েছে, প্রায় ৪২০ পিপিএম এ!

পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইডের এরকম বৃদ্ধির কারণে শিল্পযুগের আগের সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বর্তমানে ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (১ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বৃদ্ধি পেয়েছে—যা শুনে হয়ত খুব বেশি বলে নাও মনে হতে পারে। কিন্তু এর ভয়াবহতা বোঝা যায় যখন শুনবেন, বিজ্ঞানীরা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক, অপরিবর্তনীয় প্রভাবের পূর্বাভাস দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বড় আকারে বরফ গলে যাওয়া, সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধি এবং পরবর্তী বন্যা, চরম আবহাওয়া এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের মারাত্মক ক্ষতি।

শিল্প বিপ্লবের পর থেকে এর মধ্যেই, কার্বন ডাই অক্সাইড ‌ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়েছে, বিশেষ করে মেরু অঞ্চলগুলিতে। ফলাফল হিসেবে, হিমবাহগুলি দ্রুত গতিতে গলে সমুদ্রে ভেঙে পড়ছে এবং স্থলভাগের দিকে সরে যাচ্ছে।

কিয়োটো প্রটোকল এবং প্যারিস চুক্তির মত চুক্তিগুলির মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, এই উদ্যোগগুলি বিপর্যয় এড়াতে সফল হয় কিনা, নাকি অপর্যাপ্ত এবং দেরিতে পদক্ষেপ নেওয়ার ফল ভোগ করতে হয় আমাদের।

#গ্রিনহাউস #উষ্ণায়ন #পরিবেশ
Collected

No comments:

Post a Comment