Great reading…
ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে যুক্তরাষ্ট্র এক গভীর অচলাবস্থার মুখে পড়ে। দীর্ঘদিনের সামরিক ব্যয়, বিপুল প্রাণহানি এবং জয়ের নির্দিষ্ট কোনো আশা না থাকায় ওয়াশিংটনের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই যুদ্ধ তারা জিততে পারবে না। সুতরাং তারা সমাধানের পথ খুঁজতে বাধ্য হয়। এক সময় যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের বিপ্লবীদের আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের প্রতিনিধিদের প্যারিসে আসার আমন্ত্রণ জানায়। তাদের আশা ছিলো বিলাস, ভোগ ও আরামের সংস্পর্শে এসে জঙ্গলের লড়াকু মানুষগুলোর মন কিছুটা হলেও নরম হবে। তাদের উপলব্ধি ছিলো দীর্ঘ দিনের ক্লান্তি ও কষ্টে ভগ্ন মানুষদের আতিথ্য দেখিয়ে তারা আলোচনায় সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
হ্যানয় থেকে সাড়া আসে খুব দ্রুত। গঠিত হয় একটি চার সদস্যের প্রতিনিধি দল। দুজন পুরুষ এবং দুজন নারী। তবে যা ঘটেছিল তা যুক্তরাষ্ট্রের কল্পনারও বাইরে।
যখন প্রতিনিধি দলটি প্যারিস বিমানবন্দরে পৌঁছে তখন তাদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি পাঠানো হয়। কিন্তু তারা সে গাড়ীতে ওঠা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে শান্তভাবে বলেন- তারা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করবেন।
আমেরিকান প্রতিনিধি বিস্ময়ভরে প্রশ্ন করেন, তবে আপনারা কোথায় থাকবেন?
উত্তর আসে দৃঢ় কণ্ঠে- প্যারিসের উপকণ্ঠে বসবাসরত এক সাধারণ ভিয়েতনামী ছাত্রের বাসায়।
এই উত্তর আমেরিকানদের বিস্ময় আরও বাড়িয়ে দেয়। তারা বলেন- কিন্তু আমরা আপনাদের জন্য বিশ্বমানের হোটেল ও খাবারের ব্যবস্থা করেছি।
ভিয়েতনামী দলের নেতা তখন যে কথাগুলি বলেন তা হয়ে ওঠে ইতিহাসের এক অনন্য সাক্ষ্য। তিনি বলেন-
আমরা পাহাড়ে আপনাদের বিরুদ্ধে লড়েছি, বন জঙ্গলে ঘুমিয়েছি, গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে ছিলাম। আজ যদি কিছু সুযোগ সুবিধা পেয়েই আমার আমাদের জীবনধারা পাল্টে ফেলি। তাহলে আশঙ্কা করি আমাদের বিবেকও যে কোনো সময় যে কোনো সুবিধার কাছে বিক্রি হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন: যে ব্যক্তি নিজের বিবেক বিক্রি করে। সে একদিন তার দেশকেও বিক্রি করে।
এই সংযম, এই আত্মনিয়ন্ত্রণই ছিল তাদের শক্তি। তারা অবস্থান করেন ছাত্রের সেই সাধারণ বাসায়। কয়েকদিন পর শুরু হয় আলোচনা এবং যা শেষ হয় ১৯৭৩ সালের ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি দিয়ে।আমেরিকানরা বুঝতে পারে - যার বিলাসে গা ভাসায় না। তাদের সাথে যুদ্ধে জেতা সম্ভব না। ৬০ দিনের মধ্যে সমস্ত আমেরিকান সৈন্যকে ভিয়েতনাম ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
কিন্তু ইতিহাস এখানেই থেমে থাকেনি।
বছর কয়েক পর ভিয়েতনামের জেনারেল ভো গুয়েন জিয়াপ যিনি একাধারে ফরাসি ও আমেরিকান বাহিনীকে পরাজিত করেন। তিনি এক আরব দেশের রাজধানী সফর করেন। সেখানে তিনি 'বিপ্লবী' দলের নেতৃত্বকে দেখতে পান। তারা রাজপ্রাসাদে বাস করছেন, বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করছেন, কিউবান সিগারেট ফুঁকছেন ও সুগন্ধি উপভোগ করছেন।
জিয়াপ তখন তাদের উদ্দেশ্যে বলেন:
আপনাদের বিপ্লব কখনোই সফল হবে না।
তারা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, কেন?
তার জবাব তখন হয়ে ওঠে ইতিহাসের এক মহামূল্যবান বাণী। তিনি বলেন- বিপ্লব এবং বিলাস কখনো একসাথে চলতে পারে না। যে বিপ্লব চেতনা ও নীতির দ্বারা চালিত নয়, তা সন্ত্রাসে পরিণত হয়। গণবিপ্লব তখন গণতাণ্ডবে রূপ নেয়। আর যে বিপ্লবে টাকার বন্যা বইতে থাকে তার নেতারা ধীরে ধীরে জনগণের শত্রুতে পরিণত হয়।
ভিয়েতনামের সংগ্রাম শুধুমাত্র কোনো যুদ্ধ ছিলো না। বরং ছিলো এক বিবেকের লড়াই। যেখানে অস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী ছিল আদর্শ, আর বিলাসের চেয়েও মূল্যবান ছিল আত্মত্যাগ।
Comments
Post a Comment