পড়তে পারেন- আমার প্রথম গল্প।
২০১৫ সালে লেখা। এটি দিয়েই আমার গল্প লেখা শুরু। ছাপিয়েছিল প্রথম আলো।
অলৌকিক আঙুল
বাদল সৈয়দ
তার আঙুলগুলো প্রজাপতির মতো নাচছে।
ওগুলো বাজাতে চায়, কিন্তু পারছে না। বয়স আঙুলের শক্তি চুষে ফেলেছে। তারপরও তার আঙুল বিটোফেনের মুনলাইট সোনাটার সাথে চেয়ারের হাতলে নাচছে। যেন চেয়ারটিই পিয়ানো।
সাথে তার শরীর কাঁপছে। পারকিনসন না সোনাটার মূর্ছনায় বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ঝুঁকে এসে মনোযোগের সাথে কান পাতছেন সোনাটায়।
আমার মাথা রিনঝিন করছে। নেশা নেশা ভাব। পুরো রুমটা মনে হচ্ছে হালকা তুলোর মতো ভাসছে। পিয়ানোয় বিটোফেন সৃষ্টি করেছেন পরাবাস্তবতা।
আমি তার দিকে তাকাই। তিনি এখনো ঝুঁকে আছেন। হঠাৎ আমার নিজের মধ্যেই প্রশ্ন জাগে—কে বেশি শক্তিশালী? বিটোফেন না তিনি?
ভদ্রলোকের সাথে যোগাযোগ হয়েছে প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে। কোনোরকমেই আমার তার কাছে যাওয়ার কথা না ছিল।
বলা হয়, ওয়াশিংটনের সাদা বাড়ির ভদ্রলোকও তার সাথে দেখা করতে গেলে ছয় মাস আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়।
আমার তার সাথে শুধু দেখা হওয়ার কথা স্বপ্নে। কিন্তু তিনি বসে আছেন আমার সামনে—কান পেতে শুনছেন মুনলাইট সোনাটা।
তার নিজের বাজানো।
বাজছে রেকর্ডে!
একটু বোধ হয় ঠান্ডা লাগছে। আমি তার গাউনের উপর কম্বল চাপিয়ে দিলাম । তিনি চোখের ভাষায় ধন্যবাদ দিয়ে আবার মনোযোগ দিলেন মুনলাইট সোনাটায়। বলা যায় নিজের সৃষ্টিতে। কারণ তার আঙুলে জার্মান সুরকার বিটোফেন পুনঃজন্ম নিয়েছেন।
কয়েক মাস হলো নিউইয়র্ক এসেছি।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি পাঠিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভের সাথে মুদ্রা বিষয়ক একটি কাজে। কদিন হলো ক্রিসমাসের ছুটি শুরু হয়েছে—লম্বা ছুটি। আমি ফ্রিজ ভরতি খাবার নিয়ে নিজ ডেরায় আশ্রয় নিয়েছি। ইচ্ছে আছে ছুটির সময়ে কাজ এগিয়ে রাখব। বের-টের হবো না।
এই জম্পেশ ঠান্ডায় আমার ক্রিসমাস পালনের কোনো ইচ্ছে নেই।
প্রথম দিন আরামসে ঘুমালাম। দুপুরে খাবার বাদ গেলো। সন্ধ্যায় স্যান্ডউইচ আর কড়া টার্কিশ কফি নিয়ে বসেছি, এমন সময় ফোন।
বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরতেই রিনঝিন কণ্ঠ ভেসে এলো—
“লং আইল্যান্ডস হ্যাভেন হাসপাতাল। আমি কি সায়েদের সাথে কথা বলছি?”
একটু ভড়কে গেলাম—হাসপাতাল! ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, সায়েদ বলছি।”
“হ্যাপি ক্রিসমাস, সায়েদ। আমি হ্যাভেন হাসপাতাল থেকে বারবারা বলছি। তুমি তো আমাদের ‘I am with you’ প্রোগ্রামের ভলান্টিয়ার, তাই না?”
প্রথম বুঝতে পারলাম না, রিনঝিন কণ্ঠ কীসের কথা বলছে।
তারপর বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ল—এখানকার হাসপাতালগুলোতে নিঃসঙ্গ রোগীদের সময় দেয়ার জন্য কিছু প্রোগ্রাম থাকে। ‘I am with you’ সেরকম একটি প্রোগ্রাম।
অনেক আগে যখন এখানে ছাত্র ছিলাম, তখন আমিও নাম ভলান্টিয়ার হিসেবে লিখিয়েছিলাম। তারপর ভুলেই গিয়েছি। কিন্তু ওরা ভুলে নি…
আমি বললাম, “হ্যাঁ, দশ বছর আগে সদস্য হয়েছিলাম। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি।”
রিনঝিন কণ্ঠ বললো, “তা ঠিক, হয়ত দরকার পড়েনি। তবে আমার কম্পিউটার বলছে—আমাকে তুমি এখন সাহায্য করতে পারো। কারণ, তুমি লিখেছ, ভলান্টিয়ার করার জন্য তোমার পছন্দের সময় হচ্ছে ক্রিসমাসের ছুটি।”
আমি ফরমে তাই লিখেছিলাম। কারণ ছাত্রজীবনে আমার ছিল হতদরিদ্র অবস্থা। স্কলারশিপ আর টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টের টাকায় খাবারই ঠিকমত জুটত না। তার আবার ক্রিসমাস!
ওপারে মেয়েটি অপেক্ষা করছে। আমি লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, বলেছিলাম। কী করতে হবে বলো।”
টেলিফোনে স্বস্তি নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ ভেসে এলো। তারপর বারবারা বলল,
“আমাদের একজন বয়স্ক রোগী। কিছুদিন থেকে এখানে আছেন, আরো থাকতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, ছুটির সময় তার সঙ্গ দরকার, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি কি তাকে সঙ্গ দিতে পারবে?”
“আমাকে কি রোগীর ব্যাপারে আইডিয়া দিতে পারো?” জিজ্ঞেস করলাম।
“সরি, আপাতত সেটা বলা যাবে না। এই রোগীর সব তথ্য ক্লাসিফায়েড। আমি নিজেও ডিটেইল জানি না। তুমি যদি রাজী থাকো তাহলে তোমাকে ওনার ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে। তবে একটি নন-ডিসক্লোজার বন্ড সই করার পর। যেখানে তুমি বলবে, কখনোই তুমি তার কোনো তথ্য প্রকাশ করবে না। এটাতে সই না করলে কাজটা তোমাকে দেওয়া হবে না।”
বেশ বিরক্তই লাগছিল। ছাত্রজীবনের মমতাভরা হৃদয় এখন বাস্তবতার কাঠিন্যে কঠিন হয়ে গেছে। তখন যেটা করতে মন চাইতো, তা এখন চায় না। তারপরও ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করল না—বয়স্ক একজন নিঃসঙ্গ মানুষ সঙ্গ চাইছেন…
বারবারাকে বললাম, “ঠিক আছে, কখন আসব?”
“কাল সকাল নটায়, ইফ ইউ প্লিজ।”
রিনঝিনি কণ্ঠ ফোন রেখে দিলো।
পরদিন সকালে নিউইয়র্কে চৌদ্দ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়েছে—মাইনাস তেরো। ভোরে উঠে রাজ্যের কাপড় পরে, গাড়িতে স্নো টায়ার লাগিয়ে রওনা দিলাম। মনে মনে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছি, নিজের আর হাসপাতালের। ইউএস টেলিফোন নাম্বার না পাল্টানোর জন্যও রাগ হচ্ছে। সেটা করলে এরা আমাকে খুঁজে পেতো না।
হাসপাতালে ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর রোগীর ফাইল এলো। তার আগে আমার বন্ড নেওয়া হয়েছে। যা দেখব তা প্রকাশ করা যাবে না। বিরক্তিতে গা গরম হয়ে যাচ্ছে। ঘোড়ার ডিমের এক রোগী আর ব্যাটারা এমন ভাব করছে যেন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে আমার হাতে তুলে দিচ্ছে!
ফাইল দেখার পর ঘোড়ার ডিম নয়—যেন আস্ত হিমালয় আমার মাথায় ভেঙে পড়ল। ফাইল নয়, উত্তপ্ত লাল আগুন! হাত পুড়ে যাচ্ছে।
এ লোক হাসপাতালে! কেউ জানে না!
এটা তো ‘বিশ্বসংবাদ’ হতে পারতো!
বলা হয় আলোর গতিতে তার আঙুল নাচে। আসলেই কি তার আঙুল না ঈশ্বরের? কিছু ভক্ত এ প্রশ্নও তোলেন। তবে তার আঙুলে পিয়ানোতে যে সুর উঠে তা দেবতাদের সুর—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তিনি সুরের দেবতা।
তার হাতে সুরের রঙ ফুটে।
একেক সময় একেক রঙ—বিটোফেনের পঞ্চম সিম্ফনি হলে সোনালী আর মুনলাইট সোনাটা হলে তীব্র বেগুনি! মানুষ গত কয়েকশ বছরে এমনভাবে আর কারো হাতে সুরকে নাচতে দেখেনি।
তিনি হাসপাতালে। আর আমাকে দেওয়া হয়েছে তাকে সঙ্গ দেওয়ার দায়িত্ব!
শতবছর গল্প করলেও এ গল্প ফুরাবে না!
তার জীবনের গল্প দুনিয়ার সঙ্গীতপ্রিয় মানুষের মগজে গেঁথে আছে। জন্ম নিয়েছিলেন পোল্যান্ডে। হিটলারের ভয়ে তার বাবা যখন আমেরিকায় পালিয়ে আসেন তখন বয়স দশ। হার্ভার্ডে সংগীত নিয়ে পড়তে যান ১৯৫৫ সালে।
৩০ বছর বয়সে বিটোফেনের ৩২টি সনেট গুচ্ছ সুরে বাঁধেন। শুধু এ কাজটির জন্যই তিনি ইতিহাস হয়ে থাকতে পারতেন। কারণ বিটোফেনের সুর নিয়ে এমন কাজ করার সাহস এর আগে কেউ করেননি।
তারপর থেকে যা করেছেন, মনে হয়েছে তিনি নন—‘উপরের উনি’ তার আঙুলে ভর করেছেন। তিনিই পিয়ানোতে ফুটাচ্ছেন সুর।
১৯৬৮ সালে নিউইয়র্কে মেরিলিন মনরো তার বাজনা শুনতে এসেছিলেন। কথা ছিল অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চে এসে তিনি শিল্পীকে ধন্যবাদ দেবেন। কিন্তু মাঝ অনুষ্ঠানেই কোনো কথা না বলে মেরিলিন উঠে যান। পরে বাড়ি ফিরে ত্রিশটি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে যান। হাসপাতালে তিনি নাকি প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে বলেছিলেন—
“আগের সন্ধ্যায় শোনা সেই সুরের রেশ হারিয়ে যাওয়ার আগে মরে যাওয়া ভালো।”
আমার হাতে হালকা গরম কফি। বাড়িয়ে দিলে তিনি চুমুক দিচ্ছেন। বাচ্চাদের মতো চুকচুক আওয়াজ করছেন। মৃদু হাসছেন। ধন্যবাদের হাসি। তারপর আবার ঝুঁকে পড়ে নিজের রেকর্ড করা সুর শুনছেন। হালকা সুরে মিউজিক সিস্টেমে বাজছে সিম্ফনি সাত, তারপর আট। চলতে থাকবে বত্রিশ পর্যন্ত। তারপর প্রথম দিনের আলো ফুটে উঠলে লালরঙ ভোরে তিনি ঘুমাতে যাবেন। এরপর সন্ধ্যা অবধি আমার ছুটি।
তিনি কথা বলেন খুব কম। যখন বলেন খুব নিচু গলায় নম্রভাবে বলেন। আবার মাঝে মাঝে দেখি তার চেহারা টকটকে লাল হয়ে গেছে। বোঝা যায়, খুব রেগে আছেন। কার উপর তা বোঝা যায় না। সে সময় আমি একদম চুপ থাকি।
আবার কখনো ঘোরের মধ্যে চলে যান। শুধু হাত কাঁপতে থাকে, মনে হয় পিয়ানো খুঁজে, কিন্তু পায় না। তখন কিছু বললেও বোঝেন না। সম্ভবত তখন তিনি চলে যান অতীতে—যখন মানুষ মাঝরাতেও লাইনে দাঁড়িয়ে তার কনসার্টের টিকিট কিনত। যখন ঈশ্বর কথা বলতেন তার আঙুলে ভর করে।
মাঝে মাঝে দুষ্টামিও করেন। একদিন রহস্য করে বললেন,
‘হার্ভাডকে দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ বিশ্ববিদ্যালয় কেন বলা হয় জানো?’
‘কী! হার্ভার্ড খারাপ?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘অবশ্যই খারাপ। তুমি জানো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ সফল হয়। বাকিরা হারিয়ে যায়। অথচ এরা সারা দুনিয়া ওলট-পালট করে সেরা মেধাবীদের জড়ো করে, কিন্তু ফিরিয়ে দেয় তার অর্ধেক। তাহলে কি দাঁড়ালো? হার্ভার্ড কি ওতো ভালো যা তোমরা ভাবো? তাহলে পঞ্চাশ ভাগ ছাত্র হারিয়ে যায় কেন?’
একধরনের ঘোরের মধ্যে ছুটি শেষ হয়ে এলো।
আমার ডিউটির সময়ও।
এরপর আবার হাসপাতাল তার দায়িত্ব নেবে। অবশ্য তিনি এখন প্রায় সুস্থ। কিন্তু তারপরও হাসপাতাল তাকে ছাড়ছে না কিংবা তিনিই যাচ্ছেন না। খালি বাড়ির চাইতে হয়ত তার কাছে হাসপাতালই ভালো।
শেষ সন্ধ্যায় তার সাথে বসে আছি। তার মেজাজ বেশি ভালো না। বিকেলে রাগ করে গ্লাস ভেঙেছেন। হাসপাতাল থেকে বলে দেয়া হয়েছে দরকার ছাড়া কথা না বলতে। চুপচাপ বসে আছি। আজ মিউজিকও বাজছে না। নিষেধ করে দিয়েছেন। কম্বল গায়ে শুয়ে আছেন, ছাদের দিকে চোখ। সে চোখে কোন ভাব নেই, ভাষা নেই।
বাইরে তীব্র ঠান্ডা। মাইনাস ছয়। পুরো শহর যেন মৃত্যুশয্যায়। স্ট্রিট লাইটগুলো ঢাকা পড়ে গেছে বরফের চাদরে।
তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি পড়ছি। হাতে এরিক সেগালের ত্রিলার।
পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম ভাঙল চাপা গর্জন শুনে। চমকে দেখি আধা ঘুমে তিনি উঠে বসেছেন। চাপা গলায় কাকে যেন ধমকাচ্ছেন,
‘গেট লস্ট, লিভ মি এলোন, ম্যান।’
তার ঠোঁট বেয়ে নামছে লালা। আমি ধড়মড় করে উঠে বসে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। কম্বলের নিচে ছোট্ট শরীর থরথর কাঁপছে।
কিছুক্ষণ পর কাঁপুনি থামলো। বললাম,
‘নার্স ডাকব?’
তিনি হাত নেড়ে ডিসমিস করে দিলেন। তারপর মৃদু গলায় বললেন-
‘লাইট নিভাও, পানি দাও।’
হয়ত আলোতে তার চোখ কটকট করছে। আমি লাফ দিয়ে উঠে পানি নিয়ে এলাম, তিনি লম্বা ঢোকে খেলেন। মনে হচ্ছে খুব তৃষ্ণার্ত। পানি খাওয়ার পর আবার বললেন,
‘লাইট নিভাও।’
আলো নেভানোর পর নেমে এলো কোমল অন্ধকার। শুধু বারান্দার হালকা বাতির ছটায় তাকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বললেন—
‘১৯৭৭।’
আমার দম বন্ধ হয়ে এলো।
১৯৭৭!
প্রথম দিনেই বন্ডে লেখা ছিল, তার সামনে এই শব্দটা উচ্চারণও করা যাবে না, প্রসঙ্গ তোলা তো দুরের কথা!
সেদিন তিনি বাজানো থামিয়ে দিয়েছিলেন!
ভরা মজলিশে পিয়ানোয় ঘুষি মেরে বলেছিলেন—
‘আমি আর কখনোই বাজাবো না, কখনোই না।’
থরথর করে কাঁপছিলেন। তারপর আবার পিয়ানোতে ঘুষি। এরপরই জ্ঞান হারালেন।
দর্শকদের সামনের সারিতে ছিলেন মোনাকোর প্রিন্স। তিনি লাফ দিয়ে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর হাসপাতালে নিয়ে যান।
ভিয়েনা অপেরা হাউসে সেদিন আসলে কী ঘটেছিল তা যদি হয় মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন—তাহলে সঙ্গীতের ঈশ্বর কেন সেদিন বাজনা ছেড়ে দিয়েছিলেন তা হচ্ছে বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
অনেক জল্পনা হয়েছে, কিন্তু উত্তর পাওয়া যায়নি।
তিনি ব্যাপারটি নিয়ে শুধু চুপই থাকেননি। ব্যাপারটা উঠালে প্রায় মারতে যান। তাই এ ব্যাপারে কথা বলা নিষেধ।
সম্ভবত এটাই শতাব্দীর সবচেয়ে রহস্যময় নীরবতা।
আর সেই নীরবতা ভাঙছেন, আমার সামনে!
১৯৭৭!
তিনি আবার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন—
‘ভিয়েনা অপেরা হাউজ, ১৯৭৭… তুমি কি জানো ব্যাপারটা?’
আমি দম বন্ধ করে বলি,
‘হ্যাঁ।’
তিনি মুখ বাঁকা করে রহস্যময় হাসি হাসেন—
‘কিন্তু কেন তা জানো না, তাই না?’
আমি ফিসফিস করে বললাম,
‘সেটা তো বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।’
তিনি প্রায় ঝুঁকে এসেছেন আমার দিকে। তার নিঃশ্বাস পড়ছে আমার মুখে।
তারপর বলতে লাগলেন—
‘চল্লিশ সালে যখন বাবা নিউইয়র্ক পালিয়ে এলেন তখন আমার বয়স দশ বছর। মা নেই। বাবা, আমি, আমার দুবছরের বড় ভাই গিবসন নিয়ে আমাদের পরিবার। কিন্তু আমাদের দুভাইয়ের মধ্যে কোনো মিল ছিল না। আমি ছোটখাটো আর গিবসন ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা। আমি ক্লাসে শেষের দিকে থাকি, গিবসন জীবনে কখনো দ্বিতীয় হয়নি। আমি খেলার মাঠে সুযোগই পাই না, আর সে টেনিসে লোকাল হিরো। পরে অল আমেরিকান ইয়ুথ র্যাংকিংয়ে সাত নম্বর ছিলো।’
তিনি হাঁপাচ্ছেন—
‘এসব আমার কাছে এসব কোন ব্যাপার ছিলো না। আমার মাথাব্যাথা ছিলো, বাবার আচরণ- তিনি তার সাথে আমার তুলনা করতেন। নিষ্ঠুর তুলনা। সে ছিল বাবার ব্লু আইড বয়। আর আমি ছিলাম গুড ফর নাথিং। আমি পরীক্ষায় খারাপ করলে আমাকে গিবসনের সাথে তুলনা করা হতো। সে টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এলে বাবা ক্রুর হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকাতেন। মমতাহীন সে দৃষ্টিতে একজন কিশোরের মরে যেতে ইচ্ছে করতো।’
’আমি গিবসনকে ঘৃণা করা শুরু করলাম। বলার অতীত ঘৃণা। সে সময় আমি আশ্রয় নিলাম পিয়ানোতে। রাতদিন পিয়ানো নিয়ে পড়ে থাকি। কিন্তু তেমন সুর ওঠেনা।
বাবা বাঁকা হাসি হাসেন, বলেন—
‘ভালো, নাইট ক্লাবের মিউজিক কন্ডাক্টর হতে পারবি। তোর বাজনা শুনে মাতালেরা নাচবে।’
তাঁর চোখে জ্বলন্ত রাগ। তিনি বলতে লাগলেন—
‘বাবার কথায় আমার গা রি রি করত। কিন্তু জেদ আমাকে পেয়ে বসে। আমাকে পিয়ানোকে বশ মানাতেই হবে।’
‘সিদ্ধান্ত নেই আমি মিউজিক নিয়ে হার্ভার্ডে পড়বো। বাবাকে কিছুই বললাম না। তিনি আবার হাসবেন—হো হো, নিষ্ঠুর হাসি। নিজে নিজেই অ্যাপ্লিকেশন করলাম। তারপর রাত দিন বেজমেন্টে পিয়ানো নিয়ে পড়ে রইলাম। আমাকে চান্স পেতেই হবে, হার্ভার্ডে। বাবার জন্য সেটাই হবে আমার সেরা জবাব। কিন্তু আমি হচ্ছি বঞ্চিতদের দলে, যাদের প্রকৃতি নির্মমভাবে বঞ্চিত করে। তাই আমার আঙুলে সুর ওঠে না।’
তিনি পানি খাওয়ার জন্য থামলেন। তারপর আবার শুরু করলেন—
"আমার ভর্তি পরীক্ষার এক মাস আগে গিবসন মারা গেলো।
সারা জীবন এই কাসানোভা বেপরোয়া ছিল। মারাও গেলো বেপরোয়া ঘোড়া চালাতে গিয়ে। হর্স রাইডিং শিখছিলো।
তার মৃত্যুতে বাবার বয়স যেন হঠাৎ দশ বছর বেড়ে গেলো। রাতারাতি তিনি বুড়ো হয়ে গেলেন। তবে আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, গিবসনের মৃত্যু আমাকে তেমন কষ্ট দিলোনা। আমি বরং মনে মনে কেন জানি খুশি হলাম। মনে হলো, আপদ বিদায় হয়েছে।'
তিনি আবার পানি খেলেন। তারপর কথায় ফিরে গেলেন- 'আমি খুশি মনেই পিয়ানোতে মন দিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো কিছুতেই সুর ওঠে না। আমার মন খারাপ। হার্ভার্ড ডেট দিয়েছে পরীক্ষার। সারা দুনিয়ার ভবিষ্যৎ মিউজিক লিজেন্ডরা সেখানে পরীক্ষা দেবে। আর আমি, এ সুর নিয়ে যাবো সেখান? আমি তীব্র আতঙ্কে সারাক্ষণ ঘামতে থাকি। আমার ঘুম হয় না, খাওয়া হয় না। আমি হার্ভার্ডে পড়তে চাই। নয়তো বাবাকে জবাব দেয়া হবে না। আমাকে একদিনের জন্য হলেও সেখানে পড়তে হবে, যে করেই হোক। কিন্তু সুর আমার কাছে অধরাই থেকে যায়।
প্রায় নার্ভাস ব্রেকডাউন নিয়ে পরীক্ষায় বসলাম। আমার সামনে পিয়ানো। আমার হাত ঘামছে, পিছলে যাচ্ছে কি-বোর্ড। আমার খুব কান্না পায়। ছুটে গিয়ে ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে।
যারা পরীক্ষা নেবেন তারা অবাক হয়ে ভাবছেন-এ গাধা এখানে কি করছে?
এমন সময় সুর উঠল। আমার আঙুলে! মনে হচ্ছিলো স্বয়ং বিটোফেন নেমে এসেছেন। ছড়িয়ে দিচ্ছেন সুরের রঙ।
একজন পরীক্ষক আপন মনে বলতে লাগলেন-
‘ও মাই গড, ও মাই গড।’
আরেকজন ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলেন।"
অনেকক্ষণ কথা বলে তিনি দম নেওয়ার জন্য থামলেন। কিছুক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আবার শুরু করলেন—
"তারপর থেকেই সুর রঙ নিয়ে ফুটেছে আমার আঙুলে। বলা হয়, আলোর গতির চাইতে দুরন্ত আমার পিয়ানো। টাইমস পত্রিকা ১৯৬৮ সালের পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র হিসাবে আমার আঙুলের ছবি নিয়ে কভার করেছিল। ক্যাপশন ছিল, 'অলৌকিক আঙুল'।"
তারপর ১৯৭৭ সাল!
আমি দমবন্ধ উত্তেজনায় জিজ্ঞেস করলাম,
‘সেদিন কি হয়েছিল? কেন বাজানো ছেড়ে দিলেন?’
‘কারণ সেদিন আমার ধৈর্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার পক্ষে আর অভিনয় করা সম্ভব ছিলো না।’
‘অভিনয়?’ আমার গলা প্রায় চিৎকারের মতো শোনায়।
’হ্যাঁ—অভিনয়। হার্ভার্ডে পরীক্ষার সময় যখন আমার হাত থেকে কি-বোর্ড ছুটে যাচ্ছিলো, যখন আমি অসহায় কান্না লুকোচ্ছিলাম, যখন বোঝা যাচ্ছিল এই মাত্র আমার স্বপ্ন খুন হতে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ আমাকে কে যেন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। আমি পড়ে গেলাম। তারপর বেজে উঠলো সুর। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমি নই, পিয়ানো বাজাচ্ছে গিবসন।
আমার ভাই গিবসন, যে মারা গেছে এক মাস আগে! যে কোনোদিন পিয়ানো ধরেও দেখেনি!
সে বাজাচ্ছে আর হাসছে- দুষ্ট হাসি, আমার দিকে তাকিয়ে।
তার হাত নেচে যাচ্ছে পিয়ানোতে অদ্ভুত ক্ষীপ্রতায়।
আমি হা করে তাকিয়ে আছি, গিবসন কোত্থেকে এলো?
সে কখন পিয়ানো শিখলো?
সে তো মারা গেছে, এক মাস আগে!
আমি ছাড়া আর কেউ তাকে দেখছে না কেন?
বৃদ্ধ কাঁদছেন, কেমন যেন লালচে তার চোখের জল।
‘আমি আসলে কখনো বাজাইনি। আমি বাজাতে পারি না। বাজিয়েছে গিবসন, সারা জীবন!’
তিনি আমার হাত ধরলেন, তারপর হাউমাউ কাঁদতে লাগলেন।
আসলেই তার চোখের জল লাল।
হঠাৎ একটু দূরে সাজিয়ে রাখা পিয়ানো নিজে নিজে বেজে উঠলো।
সিম্ফনি নাইন!
বিটোফেন!
ধোঁয়া ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, কি-বোর্ডে নেচে যাচ্ছে অশরীরী আঙুল।
অলৌকিক আঙুল?
(পরে গল্পটি আমার গল্পগ্রন্থ 'অলৌকিক আঙুল'-এ স্থান পায়)
#আসুনমায়াছড়াই
#BadalSyed
Comments
Post a Comment